চীবর ত্যাগ করার প্রকৃত নিয়ম বা শিক্ষা
সংকলন ও সম্পাদনায়, স্থবির এম ধর্মবোধি ভান্তে,
অধ্যক্ষ, আবদুল্লাপুর শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার,
সম্পাদক ও প্রকাশক, জ্ঞান অন্বেষণ অনলাই নিউজ।
পাটিমোক্খের প্রথম শিক্ষাপদটি শুরু হয়েছে একটি বাক্য দিয়ে, আর সেটা হচ্ছে, যে-সব ভিক্ষু চীবর ত্যাগ করে শিক্ষা প্রত্যাখান করে গৃহীজীবনে ফিরে যায় নি, সেই সকল ভিক্ষুর ক্ষেত্রে এই শিক্ষাপদটি—এবং পাটিমোক্খের অন্যান্য প্রত্যেকটি শিক্ষাপদ—প্রযোজ্য। তাই ৰিভঙ্গ তার ব্যাখ্যা শুরু করেছে কোনটা বৈধভাবে চীবর ত্যাগ বলে গণ্য আর কোনটা নয় এই আলোচনার মধ্য দিয়ে। যেহেতু প্রকৃতপক্ষে এটি হচ্ছে সমস্ত শিক্ষাপদ থেকে রেহাই পাবার পথ, এজন্য আমি প্রথমেই এটিকে একটি আলাদা অধ্যায়ে আলোচনা করছি, কারণ কোনো ভিক্ষু যদি অবৈধ পন্থায় চীবর ত্যাগ করে, তখনো সে একজন ভিক্ষু বলে গণ্য হয়, আর সে বুঝুক বা না বুঝুক, শিক্ষাপদগুলো তখনো তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এমন অবস্থায় যদি সে কোনো পারাজিকা শিক্ষাপদ ভঙ্গ করে, তখন সে এই জীবনে আবার ভিক্ষু হওয়ার অযোগ্য হয়ে যাবে।
চীবর ত্যাগ করতে গিয়ে কোনো ভিক্ষু দৃঢ় অধিষ্ঠান নিয়ে একজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে এমন উক্তি করে, যার মানে দাঁড়ায় যে, সে শিক্ষাপদ ত্যাগ করছে। এই কাজের বৈধতা চারটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে :
১. ভিক্ষুর মনের অবস্থা
২. তার ইচ্ছা
৩. তার উক্তি
৪. সেই উক্তির একজন সাক্ষী।
মনের অবস্থা
ভিক্ষুকে অবশ্যই সুস্থ মনের হতে হবে। পাগল অবস্থায়, ব্যথায় প্রলাপ বকার সময়ে, অথবা ভুতে পাওয়া অবস্থায় যে-কোনো উক্তি করলে তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
ইচ্ছা
তার অবশ্যই ঐকান্তিকভাবে সংঘ ত্যাগ করার ইচ্ছা করতে হবে। যদি চীবর ত্যাগের ইচ্ছা ছাড়াই সে চীবর ত্যাগের কোনো উক্তি করে, তবে তা চীবর ত্যাগ হিসেবে গণ্য হয় না। উদাহরণস্বরূপ, যদি সে ঠাট্টা-মশকরা করে এমন উক্তি করে অথবা কীভাবে চীবর ত্যাগ করতে হয় তা অন্যকে দেখায়, তখন সে এমন উক্তি করলো বলেই এটি ধরা যাবে না যে সে চীবর ত্যাগ করেছে। এ ছাড়া তাকে যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে চীবর ত্যাগের উক্তি করতে বাধ্য করা হয়, অথবা যদি সে বলে এক কথা, বুঝায় অন্য কিছু—যেমনটা কথার ভুলে হয়—এরূপ হলে তা-ও চীবর ত্যাগ বলে গণ্য হয় না।
উক্তি
শিক্ষা পরিত্যাগ করার জন্য কোনো ভিক্ষু যে সমস্ত উক্তি ব্যবহার করতে পারে, তার একটি বিস্তারিত তালিকা ৰিভঙ্গ দিয়েছে দুটো পদ্ধতি অনুসরণ করে। প্রথম পদ্ধতিটি এরূপ, “আমি x কে পরিত্যাগ করি,” এখানে x-এর বদলে বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ, বিনয়, পাটিমোক্খ, ব্রহ্মচর্য, উপাধ্যায়, আচার্য, সব্রহ্মচারী, অথবা কোনো সমতুল্য শব্দ বসানো যায়। এই পদ্ধতির অন্যান্য বিকল্প রূপগুলো হচ্ছে : “আমি x কে নিয়ে ক্লান্ত,” ” x আমার কাছে কী?” “x আমার কাছে কোনো কিছু নয়,” ” আমি x থেকে ভালোই মুক্ত আছি।” দ্বিতীয় পদ্ধতিটি এরূপ : “আমাকে y হিসেবে ভাবুন,” যেখানে y-এর জায়গায় গৃহী, দায়ক বা উপাসক, শ্রামণ, অন্য নিকায়ের সদস্য, অন্য নিকায়ের অনুসারী, অথবা অন্য যে-কোনো সমতুল্য শব্দ বসানো যায়।
ৰিভঙ্গ একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে, এই উক্তিগুলো কোনো একটা শর্তের মতো করে জুড়ে দেওয়া যাবে না, যেমন—”ধরুন, আমি শিক্ষাপদ ত্যাগ করলাম”। এটিকে কোনো ইচ্ছা রূপেও ব্যক্ত করা যাবে না (“আমি যদি শিক্ষাপদ ত্যাগ করতাম (§)”; “আমি যেন শিক্ষাপদ ত্যাগ করি (§)”), অথবা প্রশ্নরূপেও ব্যক্ত করা যাবে না (“আমার কি শিক্ষাপদ ত্যাগ করা উচিত?”)। অর্থকথা এর সাথে শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে, চীবর ত্যাগ সম্পর্কিত উক্তিগুলো অবশ্যই বর্তমানকালীয় হতে হবে। তাই “আমি শিক্ষা ত্যাগ করেছি,” অথবা “আমি শিক্ষা ত্যাগ করব,” বলাটা চীবর ত্যাগের বৈধ উক্তি হবে না।
সাক্ষী
সাক্ষী হতে হবে একজন মানুষ, সে হোক পুরুষ বা নারী, তাকে হতে হবে সুস্থ মনের, এবং ভিক্ষু যা বলে তা সেই মানুষটির অবশ্যই বুঝতে হবে। বুদ্ধ মূর্তিকে সাক্ষী রেখে চীবর ত্যাগ করা, অথবা কোনো বোধিবৃক্ষের সামনে চীবর ত্যাগ করা এই আশায় যে, বৃক্ষদেবতারা তো সাক্ষী থাকলো, এমন পৌরাণিক রীতি এর মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায়।
বৈধভাবে চীবর ত্যাগ করতে যা একদম প্রয়োজনীয়, তা এই চারটি অঙ্গ দ্বারাই পরিপূর্ণ হয়। তবে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতীয়তার প্রত্যেকটি বৌদ্ধধারা এই কাজকে ঘিরে একগুচ্ছ আনুষ্ঠানিকতা গড়ে তুলেছে—যেমন, সবার কাছে নিজের সর্বশেষ দোষ স্বীকার [আপত্তি দেশনা] এবং অতীত প্রত্যবেক্ষণগুলো আবার একবার আবৃত্তি করা—যাতে করে অনুষ্ঠানটির মানসিক গুরুত্ব বাড়ে এবং পরবর্তীতে কোনো ধরনের অনুশোচনায় ভোগার সম্ভাবনা কমানো যায়।
যেহেতু চীবর ত্যাগ হচ্ছে একটি গুরুতর কাজ, এর সাথে এটি ব্যক্তির মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সুখ-শান্তিতে প্রবল প্রভাব ফেলে, তাই যথাযথ বিবেচনা করার পরে তবেই কেবল চীবর ত্যাগ করা উচিত। একবার যদি কোনো ভিক্ষু সিদ্ধান্ত নেয় যে সে আসলেই চীবর ত্যাগ করতে চায়, তাহলে তার কেবল উল্লিখিত শর্তাবলি অনুসরণ করলেই হবে না, সেই সাথে তার নিজের সংঘে বাড়তি যে-সমস্ত রীতিনীতি পালন করা হয়, সেগুলো পালন করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এতে করে নিজের এবং বাকি সবার কাছে এটি একটি চিহ্ন যে সে আন্তরিকতার সাথেই কাজ করছে এবং ধর্মের প্রতি, সংঘের প্রতি ও নিজের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাচেতনা নিয়েই কাজ করছে।
Leave a Reply