পরিবারের কোনো একজন সদস্য অসুস্থ হয়ে খুব সংকটাপন্ন অবস্থা হলে করণীয়
সংকলনে ও সম্পাদনায়, স্থবির এম ধর্মবোধি ভান্তে,
সম্পাদক ও প্রকাশক, জ্ঞান অন্বেষণ অনলাইন নিউজ পেপার।
(বুদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারে অগ্রতুল্য নিউজ পৌর্টাল)
সংকলনে ও সম্পাদনায়, স্থবির এম ধর্মবোধি ভান্তে, সম্পাদক ও প্রকাশক, জ্ঞান অন্বেষণ অনলাইন নিউজ পেপার। (বুদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারে অগ্রতুল্য নিউজ পৌর্টাল)
১. মৃত্যুপথযাত্রী কাউকে সাহায্য করার সবচেয়ে ভালো উপায়টা হচ্ছে তাকে ইতিবাচক ও শান্তিপূর্ণ মনে থাকতে উৎসাহিত করা। তার মানে হচ্ছে ঝামেলাকারী আবেগ যেমন ভয়, রাগ, অনুরাগ, হতাশা ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া। অন্যের মনকে এই অবস্থায় আনতে হলে আগে নিজের মনকে সেই অবস্থায় আনার জন্য কাজ করতে হবে, অর্থাৎ নিজেদের ভয় ইত্যাদিকে কমানোর চেষ্টা করতে হবে। যদি মৃত্যু নিয়ে আমরা নিজেরাই এমন ঝামেলাপূর্ণ আবেগে পূর্ণ হয়ে থাকি, তাহলে অন্যকে তার সেই আবেগগুলো থেকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা খুবই কঠিন হবে।
প্রিয়জনদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় তাদেরকে যেতে দেওয়াটা শিক্ষা করলে। তাদের প্রতি অনুরাগ নিয়ে থাকলে নিজের মন তো বটেই, মৃত্যুপথযাত্রীর মনও বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে। তাই শান্ত থাকা উচিত এবং তাদের যা বলার আছে, তা শান্তমনে শোনার মানসিকতা থাকা উচিত। দয়ালু হোন, সাহায্যকারী হোন, কিন্তু প্রবল আবেগীয় সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
২. মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিকেও এই বিষয়টি মেনে নিতে উৎসাহিত করতে হবে যে মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ও অনিবার্য পরিণতি। আমরা সবাই আমাদের নিজ নিজ কর্মানুসারে এসেছি, আমাদের নিজ নিজ কর্মানুসারেই আবার চলে যেতে হবে।
সব্বে সত্তা মরন্তি চ, মরিংসু চ মরিস্সরে,
তথেবাহং মরিস্সামি; নত্থি মে এত্থা সংসযো।
সকল প্রাণীই মারা যায়, মারা গেছে, এবং মারা যাবেই। একইভাবে আমিও নিশ্চিতই মারা যাবো; এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
৩. তাকে সব সময় তার ভালো কাজগুলো নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করতে হবে। তাকে আশ্বস্ত করতে হবে যে এই কুশল কর্মগুলো তাকে একটি সুন্দর পুনর্জন্ম দেবে এবং পরবর্তী জন্মে তাকে সহায়তা করবে।
কম্মস্সকোম্হি কম্মদাযাদো কম্মযোনি কম্মবন্ধু কম্মপটিসরণো। যং কম্মং করিস্সামি কল্যাণং বা পাপকং বা, তস্স দাযাদো ভবিস্সামীতি।
কর্মই আমার নিজস্ব, আমি কর্মেরই উত্তরাধিকারী, কর্ম থেকেই আমার এই জন্ম, আমি কর্মের কাছেই দায়বদ্ধ, কর্মই আমার আশ্রয়। ভালো-মন্দ যা কিছু আমি করি না কেন, আমিই তার উত্তরাধিকারী হবো। (অঙ্গুত্তরনিকায় ৬.১.৭)
৪. পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিকে এই বলে আশ্বস্ত করতে পারে যে, তাদেরকে নিয়ে তার চিন্তার কিছু নেই, সে তার মনকে নিশ্চিন্তে রাখতে পারে এবং সময় হলে নির্ভাবনায় চলে যেতে পারে।
৫. তার নামে দান করে দিন এবং অন্যান্য পুণ্য কাজ করে দিন, আর সেই পুন্যাংশ তাকে প্রদান করুন। যদি সম্ভব হয়, তাকে সশরীরে সেই পুণ্য কাজ করিয়ে নিন, অথবা তাকে সেই পুণ্যকাজের কথা অবগত করুন যাতে সে তা অনুমোদন করতে পারে।
ইধ নন্দতি, পেচ্চ নন্দতি, কতপুঞ্ঞো উভযত্থ নন্দতি।
পুঞ্ঞং মে কতনি নন্দতি; ভিয্যো নন্দতি সু্গ্গতিং গতো।
ইহকালে সুখী, পরকালেও সে সুখী। পুণ্যকর্মকারী উভয়কালেই সুখী হয়। “আমি ভালো কাজ করেছি,” এই ভেবে সে সুখী হয়। সুগতি স্বর্গলোকে গিয়ে সে সুখী হয়। (ধম্মপদ ১৮)
৬. মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির বুদ্ধশাসনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে ছোট্ট একটি বুদ্ধমূর্তি, কুয়ান ইন অথবা অন্য কোনো বোধিসত্ত্বের মূর্তিকে তার বিছানার পাশে রেখে দেওয়া যায় যাতে সে বুদ্ধের গুণাবলী স্মরণ করতে পারে।
৭. মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনার জন্য ভিক্ষু অথবা গৃহীকে দিয়ে পরিত্রাণ সূত্র পাঠ করানো যায়।
৮. তাকে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের শরণ নিতে উৎসাহিত করা উচিত। ভিক্ষুদেরকে নাস্তা অথবা দুপুরের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ করা যায় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সাজিয়ে তার জন্য সংঘদান করে দেওয়া যায়।
৯. সে যদি ভাবনা চর্চা করে থাকে, তাহলে তাকে স্মৃতি নিয়ে থাকার গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দিন। তাকে সব সময় ঘটনার উৎপত্তি ও বিলয়, যেমন চিন্তা, স্মৃতি, আবেগ, দৃশ্য ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিগুলোর উৎপত্তি ও বিলয়ের ঘটনা লক্ষ করতে উৎসাহিত করুন।
গৃহপতি, এটা সত্যি যে তোমার দেহ অসুস্থ, অশুচি ও ব্যথায় ভারাক্রান্ত। কারণ গৃহপতি, এক মুহূর্তের জন্য সুস্থ থাকাটা, এই দেহকে নিয়ে থাকার দাবি কে করবে, কেবল বোকা না হলে? তাই গৃহপতি, এভাবেই তোমার নিজেকে ট্রেনিং দেওয়া উচিত : “যদিও আমার দেহ অসুস্থ, আমার মন অসুস্থ না হোক।” এভাবেই তোমার নিজেকে ট্রেনিং দেওয়া উচিত। (সংযুক্তনিকায় ২২.১.১)
১০. তার কষ্টকে লাঘব করার জন্য ভাবনাকারী ধর্মবন্ধুদের আমন্ত্রণ করে মৈত্রী ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এমন ভাবনাকারী বন্ধু না থাকলে আপনি নিজেও তা করতে পারেন। কোনো একটি আরামদায়ক পজিশনে বসে প্রথমে নিজের প্রতি মৈত্রী দিন, এর পরে অসুস্থ ব্যক্তিকে মৈত্রী দিন। আপনি মনে মনে এই কথাগুলো বলতে পারেন, “তুমি সুখী হও। তুমি কষ্ট থেকে মুক্ত হও। তুমি ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হও। তুমি শান্তিতে থাকো।” অনুভব করুন যেন আপনার হৃদয় থেকে নিঃসারিত মৈত্রী অসুস্থ ব্যক্তির হৃদয়কে পরম মমতায় ঘিরে রেখেছে। তাকে ঘিরে যে মৈত্রীর কম্পন, সেটিকে অনুভব করুন।
১১. যদি মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি অন্য ধর্মের হয়, অথবা বুদ্ধধর্মের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা কম থাকে, তাহলে তার নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি অনুযায়ী শ্রদ্ধান্বিত হতে উৎসাহ দিন, প্রার্থনা ও ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করুন। আপনার নিজের বিশ্বাসকে তার উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করবেন না, কেননা তাতে করে অন্ধ আবেগ ও নাবোধক চিন্তা এসে মরণাপন্ন ব্যক্তির মনে ঝামেলা করতে পারে।
যদি সে কোনো ধর্ম পালন না করে, কিন্তু খোলা মনমানসিকতার অধিকারী হয়, তাহলে আপনি তার সাথে ধর্মের বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করতে পারেন, যেমন : মৈত্রী, করুণা, অনিত্যতা, চার আর্যসত্য ইত্যাদি। আপনি তার সাথে বুদ্ধ ও ত্রিরত্নের ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু তার প্রতি একটু সংবেদনশীল হোন : উগ্রতা প্রকাশ করবেন না, সে-রকম হলে হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। যদি ধর্মীয় অথবা আধ্যাত্মিক ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ না থাকে, তাহলে অন্য কোনো ব্যাপারে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করুন যাতে করে সে ক্রোধ, ভয়, লোভ, ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকতে পারে এবং একটি ইতিবাচক ও শান্তিপূর্ণ মন নিয়ে থাকতে পারে।
লক্ষণীয়
বেশির ভাগ মানুষ মরণকে নিয়ে ভীত, কারণ তারা ভবিষ্যতের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা বোধ করে। আর্য না হলে সবারই অপায়ে অর্থাৎ নরক, প্রেত অথবা পশুপাখির কুলে জন্মানোর সম্ভাবনা থেকে যায়।
দুর্গতিতে জন্মানোর ইচ্ছে আমরা কেউই করি না, তবুও অতীতের কৃতকর্মগুলো এখনো আমাদেরকে অপায়ে ঠেলে দিতে পারে। অপায়কে ভয় ও বিতৃষ্ণা নিয়ে ভাবাটা অর্থহীন, কিন্তু অপায়ের চিন্তা করা তখনই সার্থক হয় যখন মরণের আগমুহূর্তে অপায়ের কথা চিন্তা করে আমরা অকুশল কর্মের বদলে কুশল কর্মগুলোর কথা ভাবি।
আমরা সংযুক্তনিকায়ে (১১.৬.৪) দেখি, বুদ্ধ মহানামকে উপদেশ দিয়েছেন কীভাবে কোনো উপাসক আরেক অসুস্থ উপাসককে সাহায্য করতে পারে।
“মহানাম, কোনো অসুস্থ স্রোতাপন্ন উপাসককে চারটি উপায়ে আশ্বস্ত করা উচিত এই বলে: ‘বুদ্ধের প্রতি আপনার যে অবিচল শ্রদ্ধা : সেই ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণসম্পন্ন, সুগত,… আপনার এই অচলা শ্রদ্ধাতে আস্থা রাখুন; ধর্মের প্রতি আপনার যে অবিচল শ্রদ্ধা…; সংঘের প্রতি আপনার যে অবিচল শ্রদ্ধা… আর্যদের প্রিয় শীলের অধিকারী আপনি, তাতেই আপনি আস্থা রাখুন…’” এই চারটি উপায়ে কোনো অসুস্থ স্রোতাপন্ন উপাসককে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত।
যদি সে তার পিতামাতার জন্য হাহুতাশ করে, তাহলে তাকে এরূপ বলা উচিত :
“আপনি মৃত্যুর অধীন। পিতামাতার প্রতি আপনার অনুরাগ থাকুক না থাকুক, আপনাকে মরতে হবেই। আপনার পিতামাতার প্রতি অনুরাগ ত্যাগ করাটা ভালো হবে।”
… ছেলেমেয়েদের প্রতি অনুরাগ থাকলে,… পঞ্চকামগুণের প্রতি অনুরাগ থাকলে,… স্বর্গীয় সুখের প্রতি অনুরাগ থাকলে… ইত্যাদি।
এভাবে তার চিন্তাধারাকে ঠিক পথে এনে বলতে হবে, “ব্রহ্মলোকও অনিত্য। যদি আপনার মনকে ব্রহ্মলোকেরও ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারেন, পঞ্চস্কন্ধের নিরোধের সাথে মনকে রাখতে পারেন, তাহলে ভালো হয়।”
যদি অসুস্থ লোকটি সেভাবে করতে পারে, তাহলে মহানাম, আমি বলি যে এমন একজন উপাসকের সাথে আসবহীন ভিক্ষুর কোনো পার্থক্য নেই, অর্থাৎ একজনের বিমুক্তির সাথে আরেকজনের বিমুক্তির কোনো পার্থক্য নেই।”
বুদ্ধের সুপ্রাচীন, সবচেয়ে খাঁটি শিক্ষা পাওয়া যায় থেরবাদী বুদ্ধধর্মে। আর এই থেরবাদীমতে, মৃত্যুর পরপরই পুনর্জন্ম ঘটে। এই ছোট্ট বইটি অভিধর্মের ব্যাখ্যা ও সূত্রের বর্ণনাগুলোকে একত্র করে, রঙিন ছবি ও ডায়াগ্রামের সাহায্যে সহজ ভাষায় কর্মের গতি-প্রকৃতি এবং মৃত্যু ও পুনর্জন্মে কর্মের অনিবার্য ভূমিকাকে বিস্তৃতাকারে ব্যাখ্যা করেছে।
এটি আমাদেরকে এই বার্তা জানান দেয় যে, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের সাথে জড়িত কর্মিক শক্তিগুলোকে বুঝলে আমরা-
(ক) মরণাপন্ন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের একটি সুন্দর মৃত্যু ও সুন্দর পুনর্জন্ম লাভে সাহায্য করতে পারি;
(খ) মরণের সাথে অন্তর্দৃষ্টি ও বিজ্ঞতা নিয়ে মুখোমুখি হতে পারি এবং নিজেদের ভবিষ্যৎকে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি;
(গ) দান, শীল ও ভাবনা চর্চার মধ্য দিয়ে কুশল কর্মে নিজেদেরকে ক্রমাগত নিয়োজিত রাখতে পারি, যাতে করে সুগতি ও তাড়াতাড়ি নির্বাণ লাভের সম্ভাবনা বাড়াতে পারি।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, এই ব্যাপারে কীভাবে কী করতে হবে এই বইটি আমাদেরকে সেই পথই দেখায়।
Leave a Reply