গৌতম বুদ্ধের অতীত জন্ম – সুমেধ তাপস
সংকলন ও সম্পাদনায়, স্থবির এম ধর্মবোধি ভান্তে
সম্পাদক ও প্রকাশক, জ্ঞান অন্বেষণ অনলাইন নিউজ।
(বুদ্ধ ধর্মপ্রচারে অগ্রদূত অনবদ্য নিউজ পেপার)
আজ হতে লক্ষাধিক চার অসংখ্য কল্পেরও আগের কথা। তখন অমরাবতী নামে এক দর্শনীয় মনোরম নগরী ছিল। সেই সৌভাগ্যবতী নগরী সর্বদা হাতির বৃংহতি ধ্বনিতে, ঘোড়ার হ্রেষা রবে, গাড়ির ঘর্ঘর শব্দে, ভেরীর লহরি ছন্দে, মৃদঙ্গের সুমধুর তালে এবং বীণা ও গানের মধুর সুরে ঝংকৃত হতো। এ ছাড়াও পরমাদরে বন্ধুসম্ভাষণে, বায়ু সঞ্চালিত তালপাতার মর্মর ধ্বনিতে এবং ‘স্নান করো’ ‘পান করো’ ও ‘ভোজন করো’—এই দশটি সুমিষ্ট শব্দের দ্বারা সব সময় মুখরিত থাকত। সেটি ছিল সব দিক দিয়ে সুশোভিত সপ্ত রত্নসম্পন্ন এবং জনাকীর্ণ এক সমৃদ্ধ নগরী, যেন মনে হতো কোনো দেবনগরী। সেখানে সুমেধ নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন যিনি ছিলেন বহু কোটি ধনে ধনী, অঢেল ধনধান্যসম্পন্ন, অধ্যাপক, মন্ত্রধারী, ঋক-সাম-যজুঃ—এই ত্রিবেদে পারদর্শী এবং লক্ষণশাস্ত্র, ইতিহাস ও স্বকীয় ধর্মে অতুলনীয় পণ্ডিত। মাতাপিতা উভয় কুলের সাত পূর্বপুরুষ পর্যন্ত জাতিতে তিনি সুপরিশুদ্ধ ছিলেন। বংশমর্যাদায় তিনি ছিলেন অনিন্দনীয় এবং অসাধারণ ছিল তাঁর রূপলাবণ্য। তিনি অন্য কোনো প্রকার শিল্পবিদ্যা শিক্ষা না করে ব্রাহ্মণবিদ্যাই শিক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তিনি শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হয়ে পড়লেন। এরপর একদিন তাঁদের ধনরক্ষক মন্ত্রী-লিখিত লোহার পাত এনে মণিমুক্তা ও সোনারুপায় পরিপূর্ণ সিন্দুকের দরজা খুলে বালক সুমেধকে বললেন, ‘কুমার, এই ধনসম্পত্তি তোমার মাতৃকুল হতে প্রাপ্ত, এগুলো পিতৃকুলের, আর এগুলো হচ্ছে তোমার বাপ-দাদা থেকে শুরু করে সাত পুরুষের সঞ্চিত ধনসম্পদ; তুমি এই ধন সযত্নে রক্ষা করো এবং ইচ্ছানুরূপ পরিভোগ করো।’
তা শুনে ব্রাহ্মণপুত্র সুমেধ ভাবলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষগণ পরলোকে যাবার সময় এই সঞ্চিত ধনসম্পত্তির এক টাকাও সঙ্গে নিতে পারেননি। আমি যেন এগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি, আমাকে তার উপায় বের করতে হবে।’—অপদান অর্থকথা
এরপর তিনি একসময় নির্জনে বসে বসে চিন্তা করলেন, ‘পুনরুৎপত্তি ও মরণ দুঃখজনক।’ যেহেতু তিনি জন্ম-জরা ও ব্যাধি ধর্মের (স্বভাবের) অধীন, তাই তিনি সংকল্প করলেন, ‘আমি জরা-মরণবিহীন নিরাপদ স্থান নির্বাণের অন্বেষণ করব।’ মলমূত্র ও অন্যান্য বহু অশুচিতে পরিপূর্ণ এই দুর্গন্ধময় শরীরের প্রতি অনাকাঙ্ক্ষী হয়ে, নিরালয় হয়ে তা ত্যাগ করে নির্বাণে চলে যাই না কেন? যে পথ ধরে নির্বাণ লাভ হবে, সেটা নিশ্চয়ই আছে এবং থাকবে। এমন একটা পথ না থেকে পারে না। আমি সংসার হতে মুক্তির জন্য সে পথের অনুসন্ধান করব। যেমন শারীরিক-মানসিক দুঃখ বর্তমান আছে বলে সুখও বর্তমান আছে, সেরূপ ভব বিদ্যমানে ভবমুক্তিও বিদ্যমান আছে বলে আশা করা উচিত। উষ্ণতা বিদ্যমান থাকলে যেমন তার বিপরীতে শীতলতাও বিদ্যমান থাকে, তেমনই রাগ-দ্বেষ-মোহ—এই ত্রিবিধ অগ্নির বিদ্যমানে এদের নির্বাণও আকাঙ্ক্ষা করা উচিত। পাপ বিদ্যমান থাকলে যেমন পুণ্যও বিদ্যমান থাকে, তদ্রূপ জন্মগ্রহণ থাকলে জন্মের হেতু বিনাশেরও কামনা করা উচিত।
মলমূত্রে লিপ্ত পুরুষ জলপূর্ণ পুকুর বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যদি পুকুরের খোঁজ না করে, তাতে যেমন পুকুরের দোষ হয় না, তেমনই ক্লেশমল ধোয়ার উপযোগী অমৃত পুকুর বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তার সন্ধান না করলে সেটা অমৃত পুকুরের দোষ হতে পারে না।
চারদিকে শত্রুপরিবেষ্টিত অবস্থায় পালানোর পথ থাকলেও কোনো ব্যক্তি যদি পালিয়ে না যায় তা যেমন পথের দোষ নয়, তেমনই ক্লেশ দ্বারা অবরুদ্ধ ব্যক্তি যদি নির্বাণের পথ বিদ্যমান থাকতেও তার অনুসন্ধান না করে, সেটাও নির্বাণপথের দোষ নয়।
কোনো ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি যদি চিকিৎসক বিদ্যমান থাকতেও তার ব্যাধির চিকিৎসা না করায়, তা যেমন চিকিৎসকের দোষ নয়, তেমনই ক্লেশব্যাধির দ্বারা দুঃখিত পীড়িত ব্যক্তি যদি নির্বাণপথের নির্দেশকারী আচার্যের অন্বেষণ না করে, তা হলে সেটাও নির্বাণপথের নির্দেশক আচার্যের দোষ নয়।
কোনো সুখী ও স্বাধীন পুরুষের গলায় সাপ-কুকুর ইত্যাদির মৃতদেহ বেঁধে দিলে, সে যেমন তা ঘৃণার সঙ্গে ত্যাগ করে চলে যায়, তেমনই আমিও বহু পচাগলা জিনিসের আধার এই দুর্গন্ধময় শরীরের প্রতি নিরপেক্ষ ও অনাকাঙ্ক্ষী হয়ে তা ত্যাগ করে চলে যাব। ময়লা স্থানে স্ত্রী-পুরুষেরা যেমন মলত্যাগ করে অনাকাঙ্ক্ষী ও অপ্রত্যাশী হয়ে চলে যায়, সেরূপ আমিও নানা অশুচিপূর্ণ এই ভৌতিক দেহকে পায়খানাঘরে পায়খানা করে যাওয়ার মতো ত্যাগ করে চলে যাব। নৌকার মালিকগণ যেমন জীর্ণ, ছিন্নভিন্ন ও পানি ওঠে এমন নৌকার প্রতি নিরপেক্ষ ও অনাকাঙ্ক্ষী হয়ে সেটাকে ফেলে চলে যায়, সেরূপ আমিও চোখ-কান প্রভৃতি নয়টি ছিদ্রযুক্ত নিত্য গলিত অশুচিপূর্ণ এই পচা দেহকে জীর্ণ নৌকার মালিকের মতো ত্যাগ করে চলে যাব।
কোনো ব্যক্তি যদি সোনারুপার জিনিস সঙ্গে নিয়ে চোর-ডাকাতদের সঙ্গে যাবার সময় সেই জিনিসগুলো কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখলে সেগুলো পরিত্যাগ করে চলে যায়, তেমনই এই দেহও হচ্ছে মহাচোরের মতো। তাই কুশলকর্মের ব্যাঘাতের ভয়ে আমিও এই চোরের মতো শরীর ত্যাগ করে চলে যাব।—বুদ্ধবংশ
এভাবে তিনি বহু কারণ চিন্তা করে, বহু শতকোটি ধন ধনী-গরিবদের দান দিয়ে হিমালয় পর্বতে চলে গেলেন। হিমালয় পর্বতের কিছু দূরে ধম্মক নামে একটি পর্বত ছিল। সেখানে তাঁর আশ্রম ও পর্ণশালা সুন্দরভাবে নির্মিত হয়েছিল। দেবরাজ ইন্দ্র সেই আশ্রমের মধ্যে পাঁচটি দোষমুক্ত চংক্রমণপথ বা পায়চারির পথ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সুমেধ তাপস সেখানে নয় প্রকার দোষযুক্ত বস্ত্র ত্যাগ করে বারো প্রকার গুণযুক্ত চীবর পরেছিলেন। আটটি দোষযুক্ত পর্ণশালা পরিত্যাগ করে দশ প্রকার গুণসম্পন্ন গাছের নিচে অবস্থান করেছিলেন। বপিত ও রোপিত ধানের অন্ন একদম ত্যাগ করে অনেক প্রকার গুণযুক্ত ঝরে পড়া ফলমূল খেয়েছিলেন। সেই আশ্রমে বসে, দাঁড়িয়ে ও চংক্রমণ করতে করতে তিনি উৎসাহসহকারে ধ্যান করে সপ্তাহের মধ্যেই পঞ্চ অভিজ্ঞাবল ও অষ্ট সমাপত্তি লাভ করেছিলেন।—অপদান অর্থকথা
দীপংকর বুদ্ধের সাক্ষাৎ
এভাবে সুমেধ তাপস অভিজ্ঞাশক্তি অর্জন করে হিমালয়ে সমাপত্তিসুখে অবস্থানকালে জগতে দীপংকর নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর মায়ের গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ, জন্ম, সম্বোধিলাভ ও ধর্মচক্র প্রবর্তনের সময় দশ হাজার চক্রবাল কম্পিত, প্রকম্পিত ও আন্দোলিত হয়ে মহাশব্দে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এবং বত্রিশ প্রকার পূর্বনিমিত্ত দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সুমেধ তাপস গভীর সমাপত্তিধ্যানে মগ্ন থাকায় সেই মহাশব্দ শোনেননি, আর সেসব নিমিত্তও (লক্ষণ) দেখেননি।
সে সময় দীপংকর বুদ্ধ চার লক্ষ আস্রবহীন শিষ্যসহ বিচরণ করতে করতে ‘রম্যক’ নামক নগরের উপকণ্ঠে সুদর্শন মহাবিহারে অবস্থান করছিলেন। রম্যনগরবাসীগণ শুনল যে, শ্রমণশ্রেষ্ঠ দীপংকর পরম সম্বোধি লাভ করে ধর্মচক্র প্রবর্তনের পর ক্রমান্বয়ে ভ্রমণ করতে করতে তাদেরই নগরের কাছে সুদর্শন মহাবিহারে বাস করছেন। এই খবর শুনে তারা তখন ঘি, মাখনাদি ওষুধ এবং সুন্দর আচ্ছাদন, সুগন্ধি দ্রব্য, ফুল-বাতি ইত্যাদি যাবতীয় পূজার সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে প্রগাঢ় শ্রদ্ধাসহকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘমনা হয়ে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হলো এবং বন্দনা ও পূজার সামগ্রীগুলো নিয়ে পূজা করে সবাই একপাশে বসল। বুদ্ধ তাদের ধর্মোপদেশ দানে তৃপ্ত করলে সবাই আসন হতে উঠে বুদ্ধকে আগামী পরদিনের জন্য নিমন্ত্রণ করে নিজ গ্রামে চলে গেল।
পরদিন সেখানকার সব নাগরিক এক মহাদানযজ্ঞের আয়োজন করে নগরীকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে তথাগতের আগমন-পথ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করল। বর্ষাকালীন জলস্রোতে রাস্তার ভাঙা অংশ এবং অসমতল কিংবা কাদাময় স্থানগুলো নতুন মাটি দিয়ে সমতল করে তাতে সাদা রঙের বালু ছিটাতে লাগল। তার ওপর লাজ-ফুল ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন কাপড়ের ধ্বজাপতাকা উত্তোলন করল। এ ছাড়াও স্থানে স্থানে কলাগাছ রোপণ ও মঙ্গলঘট স্থাপন করল। সে সময় সুমেধ তাপস আশ্রম হতে বের হয়ে আকাশপথে যাবার সময় নিচে কর্মব্যস্ত উল্লসিত জনতাকে দেখে শিগগিরই আকাশ হতে অবতরণ করে জনগণকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘বন্ধুগণ, কোন ভাগ্যবান পুরুষের আগমন উপলক্ষে তোমাদের এই বিরাট আয়োজন?’
প্রত্যুত্তরে লোকজন তাঁকে বলল, ‘প্রভু সুমেধ, আপনি কি জানেন না যে দীপংকর বুদ্ধ সম্যক সম্বোধি লাভ করে ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছেন? সম্প্রতি তিনি দেশ পর্যটন করতে করতে আমাদের নগরসীমায় সুদর্শন মহাবিহারে বাস করছেন। আজ আমরা তাঁকে নিমন্ত্রণ করেছি। তাঁর আগমন উপলক্ষেই রাস্তাঘাট সংস্কার ও সাজানো হচ্ছে।’ এই কথা শুনে তাপস ভাবলেন, “বুদ্ধ উৎপন্নের কথা দূরে থাকুক, ‘বুদ্ধ’ এই শব্দ শোনাও জগতে অতি দুর্লভ। সুতরাং এই জনগণের সঙ্গে সংস্কারকাজে আমারও অংশগ্রহণ করা অবশ্যকর্তব্য।” এই চিন্তা করে তিনি জনগণকে অনুরোধ করে বললেন, ‘মহাশয়গণ, আপনারা যদি সম্যকসম্বুদ্ধের আগমন উপলক্ষেই এই সংস্কারকাজে আত্মনিয়োগ করে থাকেন, তা হলে অনুগ্রহ করে আমাকেও সেই পুণ্যের একজন অংশীদার করুন। আপনাদের সঙ্গে আমিও এই সংস্কারকাজে আত্মনিয়োগ করব।’
তারা আনন্দসহকারে সেই প্রস্তাবে সম্মত হলো। তারা জানত যে, এই সুমেধ তাপস হচ্ছেন মহা অলৌকিক শক্তিধর। তাই তারা তাঁকে এক কাদাযুক্ত স্থান দেখিয়ে বলল, ‘ভন্তে, আপনি এখানটি সমতল করে সুন্দরভাবে সাজান।’ সুমেধ তাপস ‘বুদ্ধ’ ‘বুদ্ধ’ বলে বুদ্ধকে উপলক্ষ করে প্রীতি উৎপন্ন করে ভাবলেন, আমি ইচ্ছা করলে রাস্তার এই ভাঙা-অংশটুকু আমার অলৌকিক শক্তিবলে অল্প সময়ে অনায়াসে সংস্কার করতে পারি। কিন্তু তাতে আমি তৃপ্ত হব না। বরং আজ আমি কায়িক শ্রমের দ্বারা কাজটি সম্পন্ন করে বুদ্ধের সেবা করব। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি নিজ হাতে মাটি আহরণ করে সেই অংশটি সংস্কার করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর কাজ শেষ হবার আগেই মারজিৎ দীপংকর মহামুনি ষড়ভিজ্ঞ, সমদর্শী এবং বিগতমল চার লক্ষ ক্ষীণাস্রব শিষ্যসহকারে রাস্তায় পৌঁছে গেলেন। দেবমনুষ্যগণ আমোদিত হয়ে তাঁকে আগু বাড়িয়ে নিল এবং নানাপ্রকার ভেরিনিনাদে গগনমণ্ডল মুখরিত করে সাধুবাদ দিতে লাগল।
তখন দেবতারা মানুষদের আর মানুষেরা দেবতাদের দেখতে পাচ্ছিল। তারা উভয় পক্ষই করজোড়ে তথাগত বুদ্ধের অনুগমন করছিল। দেবগণ দিব্য তূর্যধ্বনি আর মানুষেরা মানুষিক তূর্যধ্বনি করতে করতে মহামুনি দীপংকর বুদ্ধের অনুগমন করছিল। দেবতারা আকাশ থেকে দিব্য মন্দার ফুল, পদ্ম ফুল ও পারিজাত ফুল চারদিকে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। মানুষেরা পৃথিবী থেকে চম্পক, কুসুম, কদম, নাগেশ্বর, পুন্নাগ, কেতকী ও পদ্ম শাপলা ইত্যাদি ফুল ওপরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল।
এমতাবস্থায় সুমেধ তাপস অনন্যোপায় হয়ে নিজের হিত চিন্তা করে মনে মনে বললেন, ‘বুদ্ধের জন্য প্রয়োজনে আমি নিজের জীবনও বিলিয়ে দিতে পারি। তাই তিনি যাতে কাদায় না পড়েন, সেই ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। আমি কাদায় শুয়ে পড়ব, আর চার লক্ষ আস্রবহীন অর্হৎসহ বুদ্ধ আমার পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবেন। এতে করে আমার ভাবী মঙ্গল হবে।’ এই ভেবে তিনি তাতে সেতুর মতো করে শুয়ে পড়লেন।
তিনি শায়িত অবস্থায় বুদ্ধের অপূর্ব বুদ্ধশ্রী অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে ভাবতে লাগলেন, ‘এখন আমি ইচ্ছা করলেই সব ক্লেশগুলো ধ্বংস করে সংঘভুক্ত হয়ে এদের সঙ্গেই রম্যনগরে প্রবেশ করতে পারি। কিন্তু জনসাধারণের অজ্ঞাতসারে চার আর্যসত্য ধর্মকে প্রত্যক্ষ করে আমি তৃপ্তি লাভ করতে পারব না। বরং আমি দীপংকর বুদ্ধের মতো সর্বজ্ঞতা লাভ করে অসংখ্য দেবমানবকে ধর্মনৌকায় তুলে নিয়ে ভবদুঃখ থেকে ত্রাণ করব। পুরুষোত্তম দীপংকর বুদ্ধের কাছে কৃত আমার এই শ্রেষ্ঠ কর্মের বিপাকে সর্বজ্ঞতা লাভ করে অসংখ্য প্রাণীকে মুক্ত করব। সংসারস্রোত ছিন্ন করে এবং কাম, রূপ ও অরূপ, এই ত্রিভবের কর্মক্লেশ ধ্বংস করে আর্য-অষ্টাঙ্গিক-মার্গরূপ ধর্মনৌকায় তুলে দেবমনুষ্যগণকে মুক্ত করব।’—অপদান অর্থকথা
দীপংকর বুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী
কিন্তু সবার সব প্রার্থনা কি পূর্ণ হয়? তা-ও আবার কল্প-কল্পান্তরের মধ্যে পরম দুর্লভ বুদ্ধত্ব লাভের প্রার্থনা? এমন মহান প্রার্থনা সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন আটটি বিশেষ পূর্বশর্তের পরিপূর্ণতা। সেই আটটি পূর্বশর্ত কী কী? সেগুলো হচ্ছে :
১. মানব জাতিতে জন্ম, অর্থাৎ বুদ্ধত্ব প্রার্থনাকারীকে হতে হয় একজন মানুষ। কোনো নাগ, সুপর্ণ কিংবা দেবতা এমন প্রার্থনা করলে তার সেই প্রার্থনা পূর্ণ হয় না।
২. পুরুষত্ব লাভ, অর্থাৎ মানুষ হলেও বুদ্ধত্ব প্রার্থনাকারীকে হতে হয় একজন পুরুষ। কোনো স্ত্রী, নপুংসক কিংবা উভয়লিঙ্গধারী ব্যক্তির বুদ্ধত্ব প্রার্থনা পূর্ণ হয় না।
৩. ইহজীবনেই অর্হত্ত্ব লাভের হেতুসম্পন্নতা, অর্থাৎ পুরুষ হলেও প্রার্থনাকারীকে হতে হয় সেই জন্মেই অর্হত্ত্ব প্রাপ্তির হেতুসম্পন্ন, অন্যথায় তার প্রার্থনা পূর্ণ হয় না।
৪. বুদ্ধের সাক্ষাৎ, অর্থাৎ অর্হত্ত্ব লাভের হেতুসম্পন্ন পুরুষ হলেও তাঁকে সাক্ষাৎ জীবন্ত বুদ্ধের সম্মুখেই বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করতে হয়। পরিনির্বাণপ্রাপ্ত বুদ্ধের চৈত্যে কিংবা বোধিবৃক্ষাদির মূলে প্রার্থনা করলে তা পূর্ণ হয় না।
৫. প্রব্রজ্যা, অর্থাৎ সাক্ষাৎ জীবন্ত বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করলেও তাঁকে সংসারত্যাগী প্রব্রজিত হতে হবে। গৃহী অবস্থায় প্রার্থনাকারীর বুদ্ধত্ব প্রার্থনা পূর্ণ হয় না।
৬. অভিজ্ঞাসম্পন্ন, অর্থাৎ প্রব্রজিত পুরুষ হলেও তাঁকে পঞ্চ অভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তি লাভী হতে হয়, অন্যথায় তার প্রার্থনা ফলবতী হয় না।
৭. বুদ্ধত্ব লাভের জন্য জীবন ত্যাগ, অর্থাৎ পঞ্চ অভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তিসম্পন্ন হলেও প্রার্থনাকারী প্রব্রজিত ব্যক্তি যদি নিজের জীবন বুদ্ধের উদ্দেশে উৎসর্গ করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়, তার এমন ত্যাগবলেই সেই প্রার্থনা পূর্ণ হয়ে থাকে, অন্যথায় হয় না।
৮. অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তি, অর্থাৎ জীবন উৎসর্গকারী হলেও তার যদি বুদ্ধত্বকারী বিষয়গুলোর প্রতি মহতী ইচ্ছা, উৎসাহ, প্রচেষ্টা এবং অনুসন্ধিৎসা থাকে, তবেই তার প্রার্থনা পূর্ণ হয়, অন্যথায় হয় না।
প্রার্থনাকারী ব্যক্তির মাঝে এই আটটি ধর্ম একসঙ্গে বিদ্যমান থাকলে তবেই তার বুদ্ধত্ব লাভের প্রার্থনা পূর্ণ হয়ে থাকে। সুমেধ তাপস ছিলেন এই আটটি গুণে পরিপূর্ণ। তাই তিনি বুদ্ধত্ব লাভের দৃঢ়সংকল্প নিয়ে অধীর আগ্রহে দীপংকর বুদ্ধের আগমন প্রতীক্ষা করছিলেন।—বুদ্ধবংশ
তথাগত দীপংকর সেই পথ ধরে ক্রমান্বয়ে পৌঁছে গেলেন ভূতলে শায়িত সুমেধ তাপসের কাছে। সেখানে গিয়ে তিনি তাপসের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে মণি লাগানো জানালা খোলার মতো তাঁর পঞ্চ প্রসাদপূর্ণ ঈষৎ নিমীলিত দু-চোখ মেলে কাদায় শুয়ে থাকা সুমেধ তাপসকে দেখে ভাবতে লাগলেন, ‘এই জটাধারী তাপস পরম সম্বোধি লাভের মহান সংকল্প নিয়ে এই কাদার ওপর শুয়ে পড়েছেন।’ তার সংকল্প কি পূরণ হবে?
তিনি সীমাহীন অনাগতকালের পানে দিব্যদৃষ্টি প্রসারিত করে দেখতে পেলেন—আজ হতে লক্ষাধিক চার অসংখ্য কল্প অতিবাহিত হবার পর তিনি জগতে গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন।
তারপর দক্ষিণা গ্রহণের উপযোগী, লোকবিদ দীপংকর বুদ্ধ তার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে এই ভবিষ্যদ্বাণী বললেন, হে প্রিয় শিষ্যদের, এই জটাধারী তাপসকে দেখো। এই ব্যক্তি আজ হতে অপরিমিত কল্পের পর জগতে গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন। তিনি রমণীয় কপিলবাস্তু নগর হতে বের হয়ে সম্যক প্রকারে ধ্যান এবং দুষ্কর কাজ সম্পাদন করবেন। অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বসে সুজাতার দেয়া পায়েস গ্রহণের পর নৈরঞ্জনা নদীর তীরে উপস্থিত হবেন। সেদিন নৈরঞ্জনা নদীর তীরে ক্ষীর পায়েস ভোজন করবেন ও দেবতাগণের সাজানো উত্তম রাস্তায় মহাবোধি বৃক্ষমূলে আসবেন। তারপর মহাযশস্বী নরশ্রেষ্ঠ বোধিসত্ত্ব বোধিমণ্ডপ প্রদক্ষিণ করে অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। তাঁর মাতার নাম হবে মহামায়া, পিতার নাম হবে শুদ্ধোদন এবং তাঁর নাম হবে গৌতম। আস্রবহীন, কামরাগাদি ময়লা-বিরহিত, শান্ত ও একাগ্র চিত্ত সারিপুত্র এবং মৌদ্গল্যায়ন নামের দুইজন হবেন তাঁর অগ্রশ্রাবক। আনন্দ নামের সেবক তাঁকে সেবা করবে। আস্রবহীনা রাগাদি ময়লাবিহীনা শান্ত ও একাগ্র চিত্তসম্পন্না ক্ষেমা ও উৎপলবর্ণা নামের দুজন হবেন তার অগ্রশ্রাবিকা। অশ্বত্থ গাছ সেই ভগবান বুদ্ধের বোধিবৃক্ষ বলে কথিত হবে। চিত্ত ও হত্থক আলবক গৃহপতি হবেন গৃহীদের মাঝে তাঁর অগ্রসেবক। উত্তরা আর নন্দমাতা হবেন উপাসিকাদের মাঝে তাঁর অগ্রসেবিকা।
অতুলনীয় মহর্ষি দীপংকর বুদ্ধের এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে দেবনরগণ জানল, ‘তিনি বুদ্ধ বীজাঙ্কুর।’ তাই তারা আনন্দিত হলো। দশ হাজার চক্রবালবাসী দেবমনুষ্যগণ মহানন্দের কলরোল তুলল, করতালি দিয়ে হাসতে লাগল এবং হাতজোড় করে বন্দনা জানাতে লাগল সুমেধ তাপস নামের এই বোধিসত্ত্বকে। তারা বলাবলি করতে লাগল, যদি এই বুদ্ধের শাসন হারাই, তা হলে অনাগতকালে এরই সম্মুখীন হবো। যেমন মানুষেরা নদী পার হবার সময় ওপরের ঘাট হারিয়ে নিচের ঘাটে গিয়ে মহানদী উত্তীর্ণ হয়, সেরূপ আমরা সবাই যদি এই বুদ্ধকে হারাই তা হলে ভবিষ্যতে এর সম্মুখীন হয়ে মুক্তিলাভ করব।
আহুতি গ্রহণকারী দক্ষিণার্হ লোকবিদ দীপংকর বুদ্ধ তখন সুমেধ তাপসের ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁকে আট মুঠো ফুল দিয়ে বরণ করলেন। সেই পরিষদে যেই বুদ্ধপুত্রগণ ছিলেন, তাঁরাও তাকে প্রদক্ষিণ করেছিলেন। দেবতা, মানব এবং অসুরেরাও তাঁকে বন্দনা করে প্রস্থান করেছিল। সশিষ্য লোকগুরু বুদ্ধ তাঁর দৃষ্টিপথ অতিক্রম করে গেলে তখন তিনি শারীরিক-মানসিক সুখে সুখী, প্রমোদিত ও বলবতী প্রীতিতে সিক্ত হয়ে শয়ন থেকে উঠে পদ্মাসনে বসলেন।—অপদান অর্থকথা
চক্রবালবাসী দেবতাগণের আশ্বাস বাক্য
তখন চক্রবালবাসী দেবতারা মহানাদে ঘোষণা করলেন যে তিনি নিশ্চিতই বুদ্ধ হবেন। কেননা, অতীতের বোধিসত্ত্বগণ এভাবে বরপ্রাপ্ত হয়ে পদ্মাসনে উপবেশনকালে যেই নিমিত্তগুলো দেখা যেত, সেগুলো আজও দেখা যাচ্ছে।
তখন শীত লাগত না, গরমও লাগত না; দশ হাজার চক্রবাল নিঃশব্দ ও নিস্তব্ধ হয়ে যেত; মহাবায়ু প্রবাহিত হতো না, নদীর স্রোতও স্থির হয়ে যেত। তখন স্থলজ ও জলজ ফুলগুলো প্রস্ফুটিত হতো, লতা অথবা গাছ ফলভারে অবনত হতো, আকাশস্থ ও ভূমিস্থিত সব রত্ন ঝিকমিক করে আলো ছড়াত, সেগুলো আজও আলো ছড়াচ্ছে, নিশ্চয়ই আপনি বুদ্ধ হবেন।
মানুষ ও দেবতাগণের সবগুলো বাদ্যযন্ত্র আপনা থেকেই বেজে উঠত, সেগুলো আজও বেজে উঠেছে। তখন আকাশ হতে নানান রঙের বিচিত্র সুগন্ধি ফুল বর্ষিত হতো, সেসব ফুল আজও বর্ষিত হচ্ছে। তখন মহাসমুদ্র গর্জন করে উঠত, দশ হাজার চক্রবাল সগর্জনে কম্পিত হতো, এরা উভয়ই আজ মহারব করছে। তখন দশ হাজার চক্রবালের নরকগুলোর আগুন নিভে যেত, সেই নরকগুলোর আগুন আজও নিভে গেছে। সে সময় সূর্য নির্মল হতো, আর আকাশের তারকারাজি সবই দেখা যেত। আজও তাদের সেভাবেই দেখা যাচ্ছে। তখন জলধারা বর্ষিত না হলেও পৃথিবী হতে জল উঠত। আজও তেমনিভাবে পৃথিবী হতে জল উঠছে। তখন বিশাখানক্ষত্র ও চাঁদসহ সবগুলো তারা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলত, সেগুলো আজও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। তাই নিশ্চয়ই আপনি বুদ্ধ হবেন।
তখন সাপ, ইঁদুর, গুইসাপ, সিংহ, বাঘ ইত্যাদি গুহার অভ্যন্তরে আশ্রিত প্রাণীরা নিজ নিজ আশ্রয়স্থল হতে বের হয়ে আসত। আজও তারা সেভাবে নিজ নিজ আশ্রয়স্থল হতে বের হয়ে এসেছে। তখন প্রাণীদের কোনো ধরনের উৎকণ্ঠা উৎপন্ন হতো না, তারা সব সময় সন্তুষ্ট মন নিয়ে থাকত। আজও তারা সবাই সন্তুষ্ট হয়ে আছে। তখন সব রোগ উপশম হয়ে যেত, আর ক্ষুধা বিনষ্ট হতো, আজও সেসব দেখা যাচ্ছে। তখন পঞ্চ কামরাগ কম হতো এবং হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত হয়ে যেত। আজও সেগুলো দূরীভূত হয়েছে। নিশ্চয়ই আপনি বুদ্ধ হবেন।
সে সময় কোনো প্রকার ভয় উৎপন্ন হতো না। আজও তেমনিভাবে ভয় বোধ হচ্ছে না। তখন ধূলিকণা উড়ত না। আজও তেমন দেখা যাচ্ছে। তখন দুর্গন্ধ বিদূরিত হতো, সুগন্ধি প্রবাহিত হতো। আজও সেরূপ সুগন্ধি প্রবাহিত হচ্ছে। অরূপ ব্রহ্মলোকবাসী দেবতা ছাড়া সব দেবতা তখন দেখা যেত, আজও তাদের দেখা যাচ্ছে। তখন নরক পর্যন্ত সর্ব স্থান দৃষ্টিগোচর হতো, আজও সেসব দেখা যাচ্ছে। তখন দেয়াল, কবাট ও পাহাড়ের দ্বারা কোনো স্থান আচ্ছন্ন থাকত না, অর্থাৎ এদের ভেতর দিয়েও সব দেখা যেত, আজও সেসব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই আপনি বুদ্ধ হবেন।
এভাবে বরপ্রাপ্ত হওয়ার পরে বোধিসত্ত্ব পদ্মাসনে বসলে তখন সত্ত্বদের জন্মমৃত্যু হতো না। সেটা আজও দেখা যাচ্ছে। আপনি বুদ্ধত্ব লাভের জন্য দৃঢ়পরাক্রমী হোন, নিবৃত্ত হবেন না, সব সময় এগিয়ে যেতে থাকুন। আপনি যে নিশ্চয়ই বুদ্ধ হবেন, তা আমরাও জানতে পারছি।
লোকনাথ দীপংকর বুদ্ধ ও দশ হাজার চক্রবালবাসী এই উভয়ের আশ্বাসবাণী শুনে তিনি হৃষ্ট তুষ্ট প্রমোদিত চিত্তে এরূপ চিন্তা করলেন, বুদ্ধ-জিনগণ অদ্বয়বাদী ও অমোঘভাষী, মারজিন বুদ্ধদের বাক্যে অসত্য নেই, নিশ্চয়ই আমি বুদ্ধ হবো। আকাশে নিক্ষিপ্ত ঢিলের যেমন ভূমিতে পতন অবশ্যম্ভাবী, সেরূপ বুদ্ধগণের বাক্যও ধ্রুব, শাশ্বত। তাঁদের বাক্যে মিথ্যা নেই। সর্বপ্রাণীর মরণ যেমন অবশ্যম্ভাবী তেমনই বুদ্ধদের বাক্যও ধ্রুব, শাশ্বত।
বুদ্ধগণের বাক্যে মিথ্যা নেই, রাত পোহালে যেমন নিশ্চিতই সূর্যোদয় হয়ে থাকে, তেমনিভাবে বুদ্ধগণের বাক্যও সুনিশ্চিত, শাশ্বত। বুদ্ধগণের বাক্যে মিথ্যা নেই, শয়ন হতে বের হওয়া সিংহের যেমন সিংহনাদ করা নিশ্চিত, সেরূপ বুদ্ধগণের বাক্যও নিশ্চিত সত্য। তথাগতগণের বাক্যে মিথ্যা নেই, গর্ভিণী স্ত্রীলোকদের সন্তান প্রসব যেমন অবশ্যম্ভাবী, সেরূপ বুদ্ধবাণীও ধ্রুব, শাশ্বত। বুদ্ধগণের বাক্যে অসত্য নেই, নিশ্চয়ই আমি বুদ্ধ হবো।—বুদ্ধবংশ
বুদ্ধত্ব লাভের হেতু হিসেবে বিবেচিত বিষয়গুলো নির্ধারণ
‘আমি নিশ্চয়ই বুদ্ধ হতে পারব’—এমন দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে সুমেধ তাপস বুদ্ধত্বকারী বিষয়গুলো নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে চিন্তা করতে লাগলেন, কোনগুলো বুদ্ধত্বকারী বিষয়? আমি ওপরে-নিচে ও চারদিকের কাম, রূপ ও অরূপলোক পর্যন্ত যতগুলো স্বভাব ধর্ম বা বিষয় বিদ্যমান আছে, সেগুলোর মাঝ থেকে বুদ্ধত্ব লাভের হেতু হিসেবে বিবেচিত বিষয়গুলো নির্ধারণ করব।
এভাবে চিন্তা করে তিনি দেখলেন, অতীতের মহর্ষিগণ (বোধিসত্ত্বগণ) প্রথমে সম্বোধি লাভের মহাপথ হিসেবে বিবেচিত দানপারমীর চর্চা করতেন। তাই তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, যদি তুমি সম্বোধি লাভের ইচ্ছা করো, তা হলে প্রথম এই দানপারমী দৃঢ়ভাবে অধিষ্ঠান করে পরিপূর্ণ করো। পানিপূর্ণ কলসি অধোমুখী করা হলে সেই পানি যেমন নিঃশেষ হয়ে পড়ে যায়, সেখানে বিন্দুমাত্রও আর অবশিষ্ট থাকে না, সেরূপ হীন, উৎকৃষ্ট ও মধ্যম, যে-কোনো প্রকার দানপ্রার্থী দেখলে তুমিও অধোমুখী করা সেই পানির কলসির মতো নিঃশেষ করে দান করো।
এরপর তিনি ভাবলেন, কেবল এটাই বোধি পরিপূরণকারী বিষয় নয়। আরও বোধি-পরিপূরণকারী বিষয় রয়েছে। তখন অতীতের মহর্ষিগণ কর্তৃক ভাবিত-আচরিত দ্বিতীয় শীলপারমীটি তার পর্যবেক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ল। তাই তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, তুমি যদি বুদ্ধত্ব লাভ করতে ইচ্ছা করো, তবে এই শীলপারমী সম্যকভাবে গ্রহণ করে পরিপূর্ণ করো। চমরীগাইয়ের লেজ যদি কাঁটা বা অন্য কোনো ফাঁদে আটকে যায় তা হলে সে যেমন সেখানেই প্রাণ ত্যাগ করে, তবুও তার লেজ ছিন্ন করে না, সেরূপ তুমিও দাঁড়ানো, গমন, বসা ও শোয়া অবস্থায় প্রাতিমোক্ষ-সংবরণ ইত্যাদি চার প্রকার শীলভূমিতে যথাযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকে সব সময় অখণ্ডভাবে চমরীগাইয়ের লেজের মতো করে শীলগুলো রক্ষা করো।
এরপর তিনি ভাবলেন, কেবল এগুলোই বোধি পরিপূরণকারী বিষয় নয়, আরও বোধি-পরিপূরণকারী বিষয় রয়েছে। তখন অতীতের মহর্ষিগণ কর্তৃক ভাবিত-আচরিত নৈষ্ক্রম্য বা সংসারত্যাগ নামে তৃতীয় পারমীটি তাঁর পর্যবেক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ল। তাই তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, তুমি যদি সম্যক সম্বোধি লাভ করতে ইচ্ছা করো, তবে নৈষ্ক্রম্যপারমী সম্যক অধিষ্ঠান করে পরিপূর্ণ করো। কারাগারে বন্দী হয়ে থাকা ব্যক্তি যেমন বহুকাল বাস করলেও মোটেও সেখানে থাকার ইচ্ছা করে না, মুক্তিলাভেরই চেষ্টা করে, সেরূপ তুমিও কাম, রূপ ও অরূপ—এই ভবত্রয়কে কারাগারের মতো করে দেখো, আর ভব হতে মুক্তির জন্য সংসারত্যাগী হও।
এরপর তিনি ভাবলেন, কেবল এগুলোই বোধি পরিপূরণকারী বিষয় নয়, আরও বোধি-পরিপূরণকারী বিষয় রয়েছে। তখন অতীতের মহর্ষিগণ কর্তৃক ভাবিত-আচরিত প্রজ্ঞা নামে চতুর্থ পারমীটি তার পর্যবেক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ল। তাই তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, যদি তুমি সম্বোধি লাভ করতে চাও, তবে এই প্রজ্ঞাপারমী দৃঢ়তার সঙ্গে অধিষ্ঠান করে পরিপূর্ণ করো। ভিক্ষু যেমন ভিক্ষা করার সময় হীন, উৎকৃষ্ট, মধ্যম কুল কোনোটাই বাদ না দিয়ে ক্রমান্বয়ে পিণ্ডচারণ করে দ্রুত পরিমাণমতো আহার লাভ করে; সেরূপ তুমিও সব সময় পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে—‘মহাশয় কুশল কী? অকুশল কী? কর্তব্য কী? অকর্তব্য কী?’ ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করো। এভাবে তুমি প্রজ্ঞাপারমীতে পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হয়ে সম্বোধি লাভ করতে পারবে।
এরপর অতীতের মহর্ষিগণ কর্তৃক ভাবিত-আচরিত বীর্যপারমী নামে পঞ্চম পারমীটি তাঁর পর্যবেক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ল। তাই তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, যদি তুমি সম্বোধি লাভ করতে চাও, তবে বীর্যপারমী দৃঢ়তার সঙ্গে অধিষ্ঠান করে পরিপূর্ণ করো। মৃগরাজ সিংহ যেমন বসা, দাঁড়ানো ও চলাফেরা—এই ত্রিবিধ অবস্থায় অদম্য বীর্য ও প্রসারিত চিত্তে অবস্থান করে, তেমনিভাবে তুমিও সব জন্মে দৃঢ় পরাক্রমী হও। এ প্রকারে বীর্যপারমীতা পূর্ণ করে সম্বোধি লাভ করতে পারবে।
এরপর অতীতের মহর্ষিগণ কর্তৃক ভাবিত-আচরিত ক্ষান্তিপারমী নামে ষষ্ঠ পারমীটি তাঁর পর্যবেক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ল। তাই তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, তুমি এই ক্ষান্তিপারমী দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে তাতে স্থিরচিত্ত হয়ে সম্যক সম্বোধি লাভ করতে পারবে। যেমন পৃথিবীতে শুচি বা অশুচি যে-কোনো প্রকার বস্তু নিক্ষেপ করলে পৃথিবী তার প্রতি ক্রোধ বা দয়া করে না, নিক্ষিপ্ত সবকিছুকেই সহ্য করে, তেমনই তুমিও সমস্ত সম্মান-অপমান সহ্য করে ক্ষান্তিপারমী পূর্ণ করে সম্বোধি লাভ করতে পারবে।
এরপর অতীতের মহর্ষিগণ কর্তৃক ভাবিত-আচরিত সত্যপারমী নামে সপ্তম পারমীটি তার পর্যবেক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ল। তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, তুমি এই সত্যপারমী দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করো। তা দ্বারা সত্যভাষী হয়ে সম্বোধি লাভ করতে পারবে। শুকতারা যেমন সব ঋতুতেই তার নিজ স্থান থেকে চ্যুত হয় না, তেমনিভাবে তুমিও সত্যমার্গ থেকে চ্যুত হয়ো না। সত্যপারমী পূর্ণ করেই তুমি সম্যক সম্বোধি লাভ করতে পারবে।
এরপর অতীতের মহর্ষিগণ কর্তৃক ভাবিত-আচরিত অধিষ্ঠানপারমী নামে অষ্টম পারমীটি তাঁর পর্যবেক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ল। তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, তুমি এই অষ্টম অধিষ্ঠানপারমী দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে তাতে নিশ্চল থেকে সম্বোধি লাভ করতে পারবে। অচল, সুপ্রতিষ্ঠিত শিলাময় পর্বত যেমন প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ুতেও কম্পিত হয় না, নিজ স্থানেই স্থির হয়ে থাকে, তেমনিভাবে তুমিও অধিষ্ঠানে সব সময় নিশ্চল হও। এভাবে অধিষ্ঠানপারমী পূর্ণ করে সম্বোধি লাভ করতে পারবে।
এরপর অতীতের মহর্ষিগণ কর্তৃক ভাবিত-আচরিত মৈত্রীপারমী নামে নবম পারমীটি তাঁর পর্যবেক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ল। তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, তুমি এই মৈত্রীপারমী দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করো। যদি বুদ্ধত্ব লাভ করতে ইচ্ছা করো, তবে মৈত্রীগুণে অতুলনীয় হও। জল যেমন সদ্ব্যক্তি হোক আর অসৎ ব্যক্তি হোক সবাইকে শীতলতার দ্বারা শান্ত করে এবং শরীরের ময়লা বিদূরিত করে, তেমনই তুমিও শত্রু-মিত্র সবার প্রতি সমানভাবে মৈত্রী চিন্তা করো, এ প্রকারে মৈত্রীপারমী পূর্ণ করে সম্বোধি প্রাপ্ত হবে।
এরপর অতীতের মহর্ষিগণ কর্তৃক ভাবিত-আচরিত উপেক্ষাপারমী নামে দশম পারমীটি তাঁর পর্যবেক্ষণের মধ্যে ধরা পড়ল। তিনি নিজেই নিজেকে উপদেশ দিলেন, তুমি এই দশম উপেক্ষাপারমী দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করো। দাঁড়িপাল্লার মতো মধ্যস্থ হয়ে দৃঢ়চিত্ত হলে সম্বোধি লাভ করতে পারবে। পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত শুচি-অশুচি এই উভয় জিনিসের প্রতি পৃথিবী যেমন ক্রোধও করে না, অনুনয়-বিনয়ও করে না, উপেক্ষা করে থাকে—সেরূপ তুমিও সুখ-দুঃখে সব সময় দাঁড়িপাল্লার মতো মধ্যস্থভাব নিয়ে থাকো। এভাবে উপেক্ষাপারমী পূর্ণ করে সম্বোধি লাভ করতে পারবে।
এরপর সুমেধ তাপস চিন্তা করলেন, ‘জগতে বোধিসত্ত্বদের পূরণীয় বোধিপরিপক্বকারী বুদ্ধত্বকারী বিষয় বলতে এই দশটি পারমী ছাড়া অবশিষ্ট আর কিছু নেই। এই দশটি পারমীর অস্তিত্ব ওপরের আকাশেও নেই, নিচে ধরণীতলে কিংবা পূর্ব-পশ্চিম ইত্যাদি দিকেও নেই। বরং এগুলো আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরেই প্রতিষ্ঠিত।’ এভাবে তিনি পারমীগুণগুলো গভীর মনোযোগসহকারে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করলেন।
তিনি যখন এই দশ পারমী সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করছিলেন, তখন ধর্মের তেজে দশ হাজার চক্রবালসহ এই মহাপৃথিবী কেঁপে উঠেছিল। আখ পেষণকারী যন্ত্রের মতো ঘূর্ণায়মান হয়ে এই মহাপৃথিবী সগর্জনে কেঁপে উঠেছিল বার বার।
এমন মহাভূমিকম্পে ভগবান দীপংকর বুদ্ধের পরিবেশন স্থানে লোকজন কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে মূর্ছা গেল। লক্ষ লক্ষ মাটির কলসি ও ঘট পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। উদ্বিগ্ন ও ভীতসন্ত্রস্ত জনসাধারণ একত্রিত হয়ে দীপংকর বুদ্ধের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভন্তে, জগতের কল্যাণ হবে নাকি অকল্যাণ হবে? সমস্ত জগদ্বাসী উপদ্রুত হয়েছে। হে চক্ষুষ্মান, আপনি আমাদের এই সংশয় দূর করুন।’ তখন লোকনাথ দীপংকর বুদ্ধ উপস্থিত জনসাধারণকে বললেন, তোমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। এমন ভূমিকম্পে ভয় পেয়ো না। আজ আমি যাকে বুদ্ধ হবে বলে প্রকাশ করেছি, সেই ব্যক্তি অতীত বুদ্ধগণের আচরিত পারমীগুলোর ব্যাপারে বিশেষভাবে চিন্তা করেছে। বুদ্ধত্বকারী সেই পারমীগুলো তাঁর দ্বারা নিঃশেষে সুচিন্তিত হয়েছে। তাই দেবলোকসহ দশ হাজার চক্রবালে এই মহাপৃথিবী কম্পিত হচ্ছে। দীপংকর বুদ্ধের কথা শুনে তাদের মনের উৎকণ্ঠা বিদূরিত হলো। তারা সবাই মিলে তাপসের কাছে গিয়ে আরেকবার তাঁকে অভিবাদন জানাল।
এরপর সুমেধ তাপস আসন হতে উঠে দাঁড়ালে দশ হাজার চক্রবালের দেবতারা তাঁর প্রশংসা করে মঙ্গলগাথা আবৃত্তি করল :
‘আপনার দ্বারা অত্যন্ত মহৎ বিষয় প্রার্থিত হয়েছে। আপনার অভীষ্ট পূর্ণ হোক। আপনার সব বাধাবিপত্তি দূর হোক, সব রোগ বিনাশ হোক, কোনো অন্তরায় না হোক এবং আপনি শিগগিরই উত্তম বোধি লাভ করুন। যথোপযুক্ত সময়ে ফুলগাছ যেমন পুষ্পিত হয়, হে মহাবীর, সেরূপ আপনিও বুদ্ধজ্ঞানের দ্বারা প্রস্ফুটিত হোন।
অন্যান্য সম্যকসম্বুদ্ধেরা যেমন পারমী ধর্ম পূর্ণ করেছেন, মহাবীর, আপনিও তেমনই দশ পারমী পূর্ণ করুন।
অন্যান্য বুদ্ধগণ, যেমন বোধিমণ্ডপে বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন, হে মহাবীর আপনিও তেমনি জিনবোধির দ্বারা বুদ্ধ হোন।
অন্যান্য বুদ্ধগণ যেমন ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছেন, হে মহাবীর আপনিও তেমন ধর্মচক্র প্রবর্তন করুন। পূর্ণিমার চাঁদ যেমন জগদ্বাসীকে পরিশুদ্ধ আলো দান করে, সেরূপ আপনিও মনোবাসনা পূর্ণ করে দশ হাজার চক্রবালে বিরোচিত হোন।
রাহুমুক্ত সূর্য যেমন স্বীয় রশ্মির দ্বারা অত্যন্ত দর্শনীয় হয়, সেরূপ আপনিও লোকধর্ম বা সংসারবন্ধন হতে মুক্ত হয়ে বুদ্ধশ্রীর দ্বারা সুশোভিত হোন। যেমন যে-কোনো নদী মহাসমুদ্রে পতিত হয়, সেরূপ দেবগণসহ সমগ্র জগদ্বাসী আপনার কাছেই সমাগত হোক।’
এভাবে সুমেধ তাপস তাঁদের প্রশংসা লাভ করে দশ পারমী অধিষ্ঠান করে তা পূর্ণ করার জন্য মহাবনে প্রবেশ করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
অতীত বুদ্ধদের সাক্ষাৎ ও ভবিষ্যদ্বাণী
কৌণ্ডিন্য বুদ্ধ : দীপংকর ভগবানের পরিনির্বাণের পরে তাঁর শাসন এক লাখ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এরপর বুদ্ধ, অনুবুদ্ধ ও শ্রাবকেরা বর্তমান না থাকার কারণে বুদ্ধশাসনও বিলুপ্ত হয়েছিল।
এর এক অসংখ্য কল্প পরে এক কল্পে কৌণ্ডিন্য নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তিনি ষোলো লাখেরও অধিক অসংখ্য কল্প ধরে পারমী পূরণ করে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন।
বুদ্ধের উৎপত্তির ভিত্তিতে কল্প দুই প্রকার—শূন্য কল্প ও অশূন্য কল্প। শূন্যকল্পে বুদ্ধ, পচ্চেকবুদ্ধ ও চক্রবর্তী রাজা উৎপন্ন হন না। গুণবান ব্যক্তি শূন্য হওয়ার কারণে সেটাকে শূন্যকল্প বলা হয়। অশূন্য কল্প পাঁচ প্রকার : সারকল্প, মণ্ডকল্প, বরকল্প, সারমণ্ডকল্প, ভদ্রকল্প। গুণসারশূন্য কল্পে গুণসার উৎপাদক বা গুণসারদায়ক একজন সম্যকসম্বুদ্ধের আবির্ভাবের কারণে সেটাকে সারকল্প বলা হয়।
যে কল্পে দুই লোকনায়ক উৎপন্ন হন, সেটাকে মণ্ডকল্প বলা হয়। যে কল্পে তিনজন বুদ্ধ উৎপন্ন হন, তাঁদের প্রথমজন দ্বিতীয় বুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী করে যান, দ্বিতীয়জন তৃতীয় বুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তখন মানুষেরা উৎফুল্ল হয়ে নিজ নিজ প্রার্থিত বিষয়ে বর প্রার্থনা করে। তাই একে বরকল্প বলা হয়।
কোনো কল্পে চারজন বুদ্ধ উৎপন্ন হলে সেটি পূর্বের কল্প থেকে বিশিষ্টতর, সারতর বলে সারমণ্ডকল্প বলা হয়।
যে কল্পে পাঁচজন বুদ্ধ উৎপন্ন হন তাকে ভদ্রকল্প বলা হয়। সেটি অতি দুর্লভ। সেই কল্পে অধিক সংখ্যক সত্ত্ব কল্যাণ ও সুখবহুল হয়ে থাকে। অধিক সংখ্যক ত্রিহেতুক সত্ত্ব ক্লেশ ক্ষয় করে থাকে। দ্বিহেতুকেরা সুগতিগামী হয়। অহেতুকেরা হেতু লাভ করে। সে কারণে সেই কল্পকে ভদ্রকল্প বলা হয়ে থাকে।
এভাবে দীপংকর বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরবর্তী এক অসংখ্য কল্প ছিল শূন্য কল্প। সেই এক অসংখ্য কল্প পরে জগতে কৌণ্ডিন্য বুদ্ধ উৎপন্ন হন। তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব ‘বিজিতাবী’ নামে চক্রবর্তী রাজা হয়ে চন্দ্রবতী নগরে বাস করতেন। তিনি বিশাল পরিষদ-পরিবেষ্টিত হয়ে যুগন্ধর পর্বতের চূড়া থেকে শুরু করে অপরিমিত বসুন্ধরাকে বিনা দণ্ডে, বিনা অস্ত্রে, ধর্মের দ্বারা প্রতিপালন করতেন। তখন কৌণ্ডিন্য বুদ্ধ লক্ষকোটি অর্হৎ বেষ্টিত হয়ে জনপদে ভ্রমণ করতে করতে ক্রমান্বয়ে চন্দ্রবতী নগরে এসে পৌঁছালেন।
বিজিতাবী রাজা শুনলেন, ‘সম্যকসম্বুদ্ধ নাকি আমাদের নগরে এসে পৌঁছেছেন।’ তা শুনে তিনি এগিয়ে গিয়ে ভগবানের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে পরদিনের জন্য ভিক্ষুসংঘসহ বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করলেন। পরদিন ভোজন করানোর পর বুদ্ধসহ লক্ষকোটি ভিক্ষুসংঘকে মহাদান দিলেন। এরপর ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, মহাজনতার প্রতি অনুগ্রহ করে তিন মাস এখানেই বাস করুন।’ সেই তিন মাস ধরে তিনি নিরন্তরভাবে বুদ্ধসহ ভিক্ষুসংঘকে অসদৃশ মহাদান দিয়ে পরিতৃপ্ত করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ অর্থকথা
সেই লোকগুরু কৌণ্ডিন্য বুদ্ধও তাঁর ভবিষ্যৎ বিষয়ে এরূপ প্রকাশ করেছিলেন, ‘ইনি আজ থেকে লক্ষাধিক তিন অসংখ্য কল্প পরে জগতে বুদ্ধ হবেন। তিনি রমণীয় কপিলবাস্তু নগর হতে বের হয়ে সম্যক প্রকারে ধ্যান এবং দুষ্কর কাজ সম্পাদন করবেন। অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বসে সুজাতার দেয়া পায়েস গ্রহণের পর নৈরঞ্জনা নদীর তীরে উপস্থিত হবেন। সেদিন নৈরঞ্জনা নদীর তীরে ক্ষীরপায়েস ভোজন করবেন ও দেবতাগণের সাজানো উত্তম রাস্তায় মহাবোধি বৃক্ষমূলে আসবেন। তারপর মহাযশস্বী নরশ্রেষ্ঠ বোধিসত্ত্ব বোধিমণ্ডপ প্রদক্ষিণ করে অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। তাঁর মাতার নাম হবে মহামায়া, পিতার নাম হবে শুদ্ধোদন এবং তাঁর নাম হবে গৌতম। আস্রবহীন, কামরাগাদি ময়লাবিরহিত, শান্ত ও একাগ্র-চিত্ত সারিপুত্র এবং মৌদ্গল্যায়ন নামের দুইজন হবেন তাঁর অগ্রশ্রাবক। আনন্দ নামের সেবক তাঁকে সেবা করবে। আস্রবহীনা রাগাদি ময়লাবিহীনা শান্ত ও একাগ্র-চিত্তসম্পন্না ক্ষেমা ও উৎপলবর্ণা নামের দুজন হবেন তাঁর অগ্রশ্রাবিকা। অশ্বত্থ গাছ সেই ভগবান বুদ্ধের বোধিবৃক্ষ বলে কথিত হবে। চিত্ত ও হত্থক আলবক গৃহপতি হবেন গৃহীদের মধ্যে তাঁর অগ্রসেবক। উত্তরা আর নন্দমাতা হবেন উপাসিকাদের মধ্যে তাঁর অগ্রসেবিকা। সেই যশস্বী গৌতম বুদ্ধের আয়ু শতবর্ষ হবে।’
অপ্রতিম মহর্ষির এই কথা শুনে দেবমনুষ্যগণ তিনি ‘বুদ্ধবীজাঙ্কুর’ বলে আনন্দধ্বনি করতে লাগল। কেউ কেউ আনন্দে বিভোর হয়ে হাসছিল ও করতালি দিচ্ছিল, আর দেবগণসহ দশ হাজার চক্রবালবাসী হাতজোড় করে অভিবাদন জানাচ্ছিল।
তারা বলাবলি করতে লাগল, যদি লোকনাথ কৌণ্ডিন্য বুদ্ধের শাসনে অর্হৎফল লাভে বঞ্চিত হই, তা হলে অনাগতকালে এঁরই সম্মুখীন হবো। যেমন মানুষেরা নদী পার হবার সময় ওপরের ঘাট হারিয়ে নিচের ঘাটে গিয়ে মহানদী উত্তীর্ণ হয়, সেরূপ আমরা সবাই যদি এই বুদ্ধকে হারাই তা হলে ভবিষ্যতে এঁর সম্মুখীন হয়ে মুক্তিলাভ করব।
বোধিসত্ত্ব তখন কৌণ্ডিন্য বুদ্ধের কথা শুনে অত্যন্ত চিত্ত প্রসন্ন করেছিলেন এবং সেই দুর্লভ বুদ্ধত্ব সিদ্ধির জন্য জিনকে পূজা করে মহারাজ্য ত্যাগ করে তাঁর কাছে প্রব্রজিত হয়েছিলেন। সূত্র, বিনয় ইত্যাদি নবাঙ্গ বুদ্ধের শাসন অর্থাৎ বুদ্ধবাক্য ত্রিপিটক সম্পূর্ণ শিক্ষা করে বুদ্ধশাসন সুশোভিত করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব কৌণ্ডিন্য বুদ্ধের শাসনে উপবেশন, দাঁড়ান ও পদচারণ—এই ত্রিবিধ অবস্থায় অপ্রমত্তভাবে বাস করে অভিজ্ঞায় পারদর্শী হয়ে ব্রহ্মলোকগামী হয়েছিলেন।—বুদ্ধবংশ
মঙ্গল বুদ্ধ : কৌণ্ডিন্য বুদ্ধ পরিনির্বাণের এক অসংখ্য কল্প অতিক্রমের পর এক কল্পে মঙ্গল, সুমন, রেবত, শোভিত নামে জগতে চারজন বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। মঙ্গল বুদ্ধের সময়ে বোধিসত্ত্ব ত্রিবেদ পারদর্শী, শাস্ত্রজ্ঞ সুরুচি নামে অধ্যাপক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি মঙ্গল বুদ্ধের কাছে গিয়ে তাঁর শরণ গ্রহণ করে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে মালাগন্ধ দিয়ে পূজা করেছিলেন। সুগন্ধি মালা দিয়ে পূজা করে ঘন দুধ দ্বারা পরিতৃপ্ত করেছিলেন। সেই দ্বিপদোত্তম মঙ্গল বুদ্ধও তাঁর বিষয়ে এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করেছিলেন, ‘ইনি এই হতে অপরিমিত কল্প পরে বুদ্ধ হবেন।’
তখন মঙ্গল বুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে তাঁর মন অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিল। তিনি দশ পারমী পূর্ণ করার জন্য বিশেষভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন। তখন উত্তম সম্যক সম্বোধি লাভের জন্য প্রীতিবহুল হয়ে তার বাসগৃহে বুদ্ধকে পূজা করে বুদ্ধের কাছে প্রব্রজিত হয়েছিলেন। সূত্রান্ত ও বিনয়াদি নবাঙ্গ বুদ্ধশাসন অর্থাৎ বুদ্ধবাক্য ত্রিপিটক সম্পূর্ণ শিক্ষা করে জিনশাসন শোভিত করেছিলেন। প্রব্রজ্যা নিয়ে অপ্রমত্তভাবে অবস্থান করে মৈত্রী-করুণা-মুদিতা-উপেক্ষা-এ চারটি ব্রহ্মবিহার ভাবনা করেছিলেন। তা ভাবনা করে অভিজ্ঞায় পারদর্শী হয়ে ব্রহ্মলোকগামী হয়েছিলেন।—বুদ্ধবংশ
সুমন বুদ্ধ : মঙ্গল বুদ্ধের দেহ থেকে নিঃসৃত আলোয় দশ হাজার চক্রবাল সব সময় আলোকিত থাকত। দিনরাতের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। কিন্তু তাঁর পরিনির্বাণের সঙ্গে সঙ্গেই সেই আলো অন্তর্হিত হলো। দশ হাজার লোকধাতু আক্ষরিক অর্থেই মহা আঁধারে নিমজ্জিত হলো। এরপর মানুষের আয়ু নব্বই হাজার বছর থেকে ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে দশ বছরে নেমে এল। এরপর আবার ক্রমান্বয়ে মানুষের আয়ু বাড়তে বাড়তে অসংখ্য বছর হলো। আবার তা কমতে কমতে নব্বই হাজার বছর হলে তখন সুমন নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হলেন।
তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব ‘অতুল’ নামে মহাঋদ্ধিবান মহাপ্রভাবশালী নাগরাজ ছিলেন। তিনি ‘জগতে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছেন’ শুনে আত্মীয়স্বজন নিয়ে নিজের ভবন থেকে বের হয়ে লক্ষকোটি ভিক্ষুসহ সুমন ভগবানকে দিব্য বাজনা দ্বারা পূজা করে মহাদান দিলেন এবং প্রত্যেককে এক জোড়া করে কাপড় দিয়ে বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করলেন। সেই ভগবানও তাঁকে ‘অনাগতকালে তুমি বুদ্ধ হতে পারবে’ এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ অর্থকথা
রেবত বুদ্ধ : সুমন ভগবানের শাসন বিলুপ্ত হওয়ার পরে মানুষের আয়ু নব্বই হাজার বছর থেকে ক্রমান্বয়ে কমে দশ বছর হলো। আবার ক্রমান্বয়ে বেড়ে অসংখ্য বছর হলো। আবার ক্রমান্বয়ে কমে যখন ষাট হাজার বছর আয়ু হলো তখন রেবত নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হলেন।
তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব রম্যবতী নগরে ‘অতিদেব’ নামে ব্রাহ্মণ হয়ে ব্রাহ্মণধর্মে বিশেষজ্ঞ হয়েছিলেন। তিনি রেবত সম্যকসম্বুদ্ধকে দেখে তার ধর্মকথা শুনে তাঁর শরণ গ্রহণ করেছিলেন এবং হাজারটা শ্লোক দ্বারা বুদ্ধের গুণকীর্তি কীর্তন করেছিলেন এবং হাজার মুদ্রা মূল্যের চীবর দিয়ে ভগবানকে পূজা করেছিলেন। সেই ভগবানও তাঁর বুদ্ধ হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘আজ থেকে দুই লাখেরও অধিক অসংখ্য কল্প পরে গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন।’ সে সময়ও তিনি বুদ্ধত্বকারী বিষয়গুলো অনুস্মরণ করে সেগুলো পূরণের জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ অর্থকথা
শোভিত বুদ্ধ : এরপর চার অসংখ্য কল্প এবং এক লাখ কল্পেরও অধিককাল ধরে পারমী পূরণ করা শোভিত বুদ্ধ উৎপন্ন হলেন। তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব রম্যবতী নগরে ‘সুজাত’ নামে ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি শোভিত ভগবানের ধর্মদেশনা শুনে শরণ গ্রহণ করে বুদ্ধসহ ভিক্ষুসংঘকে তিন মাস ধরে মহাদান দিয়েছিলেন। তিনিও তাঁকে ‘ভবিষ্যতে আপনি গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধের কথা শুনে হৃষ্টমনা হয়ে বুদ্ধত্বকারী বিষয়গুলো পূরণের জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করছিলেন।—বুদ্ধবংশ অর্থকথা
অনোমদর্শী বুদ্ধ : শোভিত বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরবর্তী এক অসংখ্য কল্পে কোনো বুদ্ধ উৎপন্ন হননি। সেই এক অসংখ্য কল্প পরে এক কল্পে তিনজন বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন, অনোমদর্শী, পদুম ও নারদ বুদ্ধ।
অনোমদর্শী ভগবান ষোলো লক্ষ অসংখ্য কল্প ধরে পারমী পূরণ করে বুদ্ধ হয়েছিলেন। তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব এক মহাশক্তিশালী যক্ষসেনাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন মহাঋদ্ধিমান, মহাপ্রভাবশালী, অনেক লক্ষকোটি যক্ষের অধিপতি। তিনি ‘জগতে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছেন’ শুনে এসে পরম দর্শনীয়, সপ্ত রত্নময় মঞ্চ নির্মাণ করে সেখানে এক সপ্তাহ ধরে বুদ্ধসহ ভিক্ষুসংঘকে মহাদান দিয়েছিলেন। তখন ভগবান ভোজনের পরে দান অনুমোদনের সময় ‘ভবিষ্যতে এক লাখেরও অধিক অসংখ্য কল্প পরে আপনি গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন’ এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব অনোমদর্শী বুদ্ধের অমোঘবাণী শুনে তুষ্ট ও সংবিগ্ন-চিত্ত হয়ে, দশ পারমী পরিপূরণের জন্য বিশেষ ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন। এই অনোমদর্শী ভগবানের কাছেই গৌতম বুদ্ধের অগ্রশ্রাবকদ্বয় সারিপুত্র ও মৌদ্গল্যায়ন অগ্রশ্রাবকত্ব প্রার্থনা করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ অর্থকথা
পদুম বুদ্ধ : অনোমদর্শী ভগবানের পরে মানুষের আয়ু এক লাখ বছর থেকে ক্রমে কমতে কমতে দশ বছর হয়ে আবার ক্রমান্বয়ে বেড়ে অসংখ্য বছর হয়েছিল। এরপর আবার কমতে কমতে যখন এক লাখ বছরে আসল, তখন পদুম নামে বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হলেন।
পদুম বুদ্ধ একসময় গোশৃঙ্গ-শালবনের মতো পরম রমণীয় এক বনে বাস করছিলেন। তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব সেই বনে সিংহ হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। পদুম ভগবানকে সপ্তাহকাল যাবৎ নিরোধসমাপত্তিতে বসে থাকতে দেখে প্রসন্নচিত্ত হয়ে প্রদক্ষিণ করে খুশিতে তিনবার সিংহগর্জন করেছিলেন। এরপর বুদ্ধকে অবলম্বন করে উৎপন্ন প্রীতিসুখে শিকারে না গিয়ে জীবনত্যাগ করে সপ্তাহকাল বুদ্ধকে পূজা করতে করতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর বুদ্ধ সেই সপ্তাহ পরে নিরোধসমাপত্তি থেকে উঠে সিংহকে দেখে ‘ভিক্ষুসংঘকে দেখে তাঁর চিত্ত প্রসন্ন হোক’—তাই ‘সংঘ আসুক’ বলে চিন্তা করলেন। তখনই বহু কোটি ভিক্ষু এসে উপস্থিত হলেন। সিংহ তখন সংঘের প্রতিও চিত্ত প্রসন্ন করলেন। এরপর বুদ্ধ তাঁর চিত্তকে দেখে ‘ভবিষ্যতে গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ অর্থকথা
নারদ বুদ্ধ : পদুম বুদ্ধের শাসন বিলুপ্ত হওয়ার পরে মানুষের আয়ু এক লাখ বছর থেকে ক্রমান্বয়ে কমে দশ বছর হলো। এরপর আবার বেড়ে অসংখ্য বছরে গিয়ে ঠেকল। এরপর আবার কমতে কমতে যখন নব্বই হাজার বছর আয়ু হলো তখন দশবলধারী বিমুক্তিবিশারদ নারদ নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।
তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব ঋষিপ্রব্রজ্যায় প্রব্রজিত হয়ে হিমালয়ের পাশে আশ্রম নির্মাণ করে পঞ্চ অভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তিতে দক্ষ হয়ে বাস করতেন। তাঁর প্রতি অনুকম্পা করে নারদ ভগবান আশি কোটি অর্হৎ এবং আট হাজার অনাগামীফললাভী উপাসক নিয়ে তাঁর আশ্রমে গিয়েছিলেন। তাপস তখন ভগবানকে দেখে উৎফুল্ল মনে ভগবানকে সশিষ্যে থাকার জন্য আশ্রম নির্মাণ করে সারারাত বুদ্ধের গুণকীর্তন করে ভগবানের ধর্মদেশনা শুনেছিলেন। পরদিন উত্তরকুরুতে গিয়ে সেখান থেকে আহার নিয়ে সশিষ্য বুদ্ধকে মহাদান দিয়েছিলেন। এভাবে সপ্তাহকাল ধরে মহাদান দিয়ে হিমালয় থেকে অমূল্য রক্তচন্দন এনে সেই চন্দন দিয়ে ভগবানের পূজা করেছিলেন। তখন বুদ্ধ তাঁকে ধর্মকথা বলে ‘ভবিষ্যতে গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব নারদ বুদ্ধের এই অমোঘ বাণী শুনে বহুলভাবে ভাবনা করে দশ পারমী পরিপূরণের জন্য তীব্রভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ অর্থকথা
পদুমুত্তর বুদ্ধ : নারদ বুদ্ধের শাসন নব্বই হাজার বছর স্থায়ী হওয়ার পর বিলুপ্ত হলো। সেই কল্পও ধ্বংস হলো। এরপর এক অসংখ্য কল্প ধরে জগতে কোনো বুদ্ধ উৎপন্ন হয়নি। জগৎ ছিল বুদ্ধশূন্য। সেই কল্পের অসংখ্য কল্প পরে এখন থেকে লক্ষ কল্পের মাথায় এক কল্পে একজন মাত্র মারবিজয়ী পদুমুত্তর নামে বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হয়েছিলেন। পদুমুত্তর বুদ্ধের সময়ে তীর্থীয় বা অন্য ধর্মাবলম্বী বলতে কিছুই ছিল না। তখন দেবমানব সবাই বুদ্ধের শরণ নিয়েছিলেন।
তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব বহু কোটি ধনের মালিক হয়ে জটিল নামে বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত নাগরিক হিসেবে বাস করতেন। তিনি বুদ্ধসহ ভিক্ষুসংঘকে চীবরসহ শ্রেষ্ঠ বস্তু দান দিয়েছিলেন। সেই ভগবানও ভোজন শেষে দান অনুমোদনের সময় ‘ভবিষ্যতে লক্ষ কল্পের মাথায় গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বুদ্ধের এই আশ্বাসবাণী শুনে বোধিসত্ত্ব তখন বিশেষভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন। দশ পারমী পূরণের জন্য অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ধৈর্যাবলম্বন করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ অর্থকথা
সুমেধ বুদ্ধ : পদুমুত্তর বুদ্ধ পরিনির্বাণের পর জগতে সুমেধ বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। বোধিসত্ত্ব সে সময় উত্তর মানব হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাড়িতে আশি কোটি মূল্যের বিত্তসম্পত্তি সঞ্চিত ছিল। সেসব সম্পত্তি দিয়ে ভিক্ষুসংঘসহ লোকনায়ক সুমেধ বুদ্ধকে পূজা করে তাঁর শরণাগত হয়ে তাঁর প্রব্রজ্যায় রুচি উৎপাদন করেছিলেন। সেই সুমেধ বুদ্ধও দানানুমোদন করে ধর্মদেশনা করার সময় ‘ইনি ত্রিশ হাজার কল্প পরে বুদ্ধ হবেন’ বলে তাঁকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব সুমেধ বুদ্ধের বাণী শুনে তাঁর চিত্ত বিশেষভাবে প্রসন্ন করেছিলেন। দশটি পারমী পরিপূরণের জন্য আরও উত্তরোত্তর ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
সুজাত বুদ্ধ : সুমেধ বুদ্ধ পরিনির্বাণের পর জগতে সুজাত বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তখন বোধিসত্ত্ব রাজচক্রবর্তী হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধোৎপত্তির সংবাদে তিনি সেখানে গিয়ে ধর্মকথা শুনে তাঁর কোষাগারের সপ্তবিধ রত্নাদিসহ বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে দান করে স্বয়ং বুদ্ধের কাছে প্রব্রজিত হয়েছিলেন। রাজ্যবাসী প্রজাবৃন্দ বুদ্ধোৎপত্তির এই সুবর্ণ সুযোগ উপলব্ধি করে চার মহাদ্বীপব্যাপী সেই বিশাল সংঘারামে প্রত্যেকে সংঘসেবকের মতো যাবতীয় কাজ সমাধা করে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশে নিত্যই মহাদানযজ্ঞের প্রবর্তন করতেন। সুজাত বুদ্ধও বোধিসত্ত্বকে ‘বুদ্ধ হতে পারবে’ এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব সুজাত বুদ্ধের অমোঘ বাণী শুনে বিশেষভাবে প্রীতির সঞ্চার করেছিলেন। আর দশ পারমী পূরণের জন্য তীব্রভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন। তিনি সূত্র, বিনয় এবং নবাঙ্গ বুদ্ধশাসন সব ভালোভাবে শিক্ষা করে জিনশাসন শোভিত করেছিলেন। তিনি সেই বুদ্ধশাসনে অপ্রমত্তভাবে বাস করে ‘মৈত্রী-করুণা-মুদিতা-উপেক্ষা’ ব্রহ্মবিহার ভাবনা করেছিলেন। ব্রহ্মবিহার ধ্যানাভিজ্ঞায় পারদর্শী হয়ে মরণের পর ব্রহ্মলোকগামী হয়েছিলেন।—বুদ্ধবংশ
প্রিয়দর্শী বুদ্ধ : সুজাত বুদ্ধ পরিনির্বাণের পর জগতে প্রিয়দর্শী বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। বোধিসত্ত্ব তখন মন্ত্রজ্ঞ ও ত্রিবেদ পারদর্শী কাশ্যপ নামে অধ্যাপক ব্রাহ্মণরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি বুদ্ধের ধর্মশ্রবণে শ্রদ্ধান্বিত হয়ে লক্ষকোটি মুদ্রা ব্যয়ে সংঘারাম নির্মাণ করে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে দান দিয়েছিলেন। হৃষ্টচিত্তে তাঁকে বিহার দান করে, বিষয়বাসনার প্রতি উদ্বিগ্ন হয়ে দৃঢ়তাসহকারে ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল গ্রহণ করেছিলেন। সেই প্রিয়দর্শী বুদ্ধও ভিক্ষুসংঘের মধ্যে বসে ‘ইনি আঠারোশো কল্প পরে বুদ্ধ হবেন’ বলে তাঁর ভবিষ্যৎ অবস্থা নির্দেশ করে প্রকাশ করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব প্রিয়দর্শী বুদ্ধের কথা শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করে দশ পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
অর্থদর্শী বুদ্ধ : প্রিয়দর্শী সম্যকসম্বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে তাঁর শাসনও বিলুপ্ত হয়েছিল। এরপর মানুষের আয়ু ক্রমান্বয়ে কমে আবার বেড়ে অসংখ্য বছর হলো। আবার কমতে কমতে এক লাখ বছর হলে তখন অর্থদর্শী বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হলেন।
গৌতম বোধিসত্ত্ব এ সময়ে চম্পক নগরে সুসীম নামে সম্ভ্রান্ত মহাধনী ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি তাঁর সব ধনসম্পত্তি দীন-দরিদ্র, অনাথ, দুস্থজনের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে হিমালয়ের কাছে গিয়ে তাপস প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে পঞ্চ অভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তি উৎপন্ন করে মহাঋদ্ধিমান ও মহাপ্রভাবশালী হয়েছিলেন। তিনি মহাজনতাকে কুশল-অকুশল ধর্মগুলোর দোষ-গুণ দেখিয়ে বুদ্ধ উৎপন্ন হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।
এরপর একসময় অর্থদর্শী ভগবান জগতে উৎপন্ন হয়ে সুদর্শন মহানগরে অষ্ট পরিষদের মধ্যে ধর্মের অমৃত বর্ষণ করার সময় সেই ধর্ম শুনে এই তাপস স্বর্গলোকে গিয়ে দিব্য মন্দার ফুল, পদ্ম ও পারিজাত ফুল দিয়ে নিজের অলৌকিক প্রভাব দেখানোর জন্য দৃশ্যমান শরীরেই মহামেঘের মতো ফুলেল বৃষ্টি করে চারদিকে ফুলের মণ্ডপ, পুষ্পময় তোরণ ইত্যাদি করে মন্দার ফুলের ছাতা দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। সেই ভগবানও তাঁকে ‘ভবিষ্যতে গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব অর্থদর্শী বুদ্ধের আশ্বাসবাণী শুনে হৃষ্ট ও উৎকণ্ঠিত চিত্তে দশটি পারমী ধর্ম পূরণ করার জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
ধর্মদর্শী বুদ্ধ : অর্থদর্শী বুদ্ধ পরিনির্বাণের পর জগতে ধর্মদর্শী বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। বোধিসত্ত্ব সে সময় পুরন্দর নামে দেবরাজ ইন্দ্র ছিলেন। তিনি দিব্য গন্ধমালা ও তূর্যনাদ দ্বারা সম্বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। ধর্মদর্শী বুদ্ধও দেবপরিষদে বসে ‘আঠারোশো কল্প পরে তিনি বুদ্ধ হবেন’ বলে তাঁকে ভবিষ্যদ্বাণী ব্যক্ত করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব ধর্মদর্শী বুদ্ধের অমোঘ বাণী শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করে দশটি পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
সিদ্ধার্থ বুদ্ধ : ধর্মদর্শী বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে তাঁর শাসন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই কল্পের পরে সতেরোশো ছয় কল্প অতিবাহিত হলে এখন থেকে চুরানব্বই কল্প আগে এক কল্পে সিদ্ধার্থ নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।
তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব সুরসেন নগরে মঙ্গল নামে ব্রাহ্মণ হয়ে বেদে পারদর্শী হয়েছিলেন। তিনি অনেক কোটি ধন গরিব-দুঃখীদের দিয়ে একাকী বাসের জন্য তাপসপ্রব্রজ্যা গ্রহণ করে ধ্যান-অভিজ্ঞার অধিকারী হয়েছিলেন। ‘জগতে সিদ্ধার্থ নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছেন’ শুনে ভগবানের কাছে গিয়ে বন্দনা করে তাঁর ধর্মকথা শুনে যে জাম গাছের কারণে এই দ্বীপ জম্বুদ্বীপ বা জামদ্বীপ বলে খ্যাত, সেই জাম গাছে ঋদ্ধিবলে গিয়ে সেখান থেকে ফল এনে নব্বই কোটি ভিক্ষুসংঘসহ সিদ্ধার্থ বুদ্ধকে সুরসেন বিহারে বসিয়ে জামফলের দ্বারা পরিতৃপ্ত করেছিলেন। তখন বুদ্ধ সেই ফল খেয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘এখন থেকে চুরানব্বই কল্পের মাথায় গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন।’
সিদ্ধার্থ বুদ্ধের বাণী শুনে বোধিসত্ত্ব চিত্ত প্রসন্ন করে দশটি পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে বিশেষভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
তিষ্য বুদ্ধ : সিদ্ধার্থ বুদ্ধ পরিনির্বাণের পর জগতে তিষ্য বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তখন বোধিসত্ত্ব সুজাত নামে ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন। প্রচুর ভোগসম্পত্তি ত্যাগ করে ঋষিপ্রব্রজ্যায় প্রব্রজিত হয়েছিলেন। তিনি প্রব্রজিত হলে লোকনায়ক বুদ্ধের আবির্ভাব হয়েছিল। ‘বুদ্ধ’ এই অশ্রুতপূর্ব কথা শুনে তাঁর প্রীতির সঞ্চার হয়েছিল। তিনি দিব্য মন্দার, পদ্ম ও পারিজাত ফুল করজোড়ে গ্রহণ করে বল্কল চীবর ঝেড়ে গিয়েছিলেন। চার পরিষদ-পরিবৃত লোকনায়ক তিষ্য বুদ্ধের কাছে গিয়ে সেই ফুলমঞ্জরি জিনের মাথার ওপর ধারণ করেছিলেন। তখন সেই তিষ্য বুদ্ধও জনসভায় বসে ‘এই ঋষি এখন হতে বিরানব্বই কল্প পরে বুদ্ধ হবেন’ বলে প্রকাশ করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব তিষ্য বুদ্ধের কথা শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করে দশটি পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
ফুস্স বুদ্ধ : তিষ্য বুদ্ধ পরিনির্বাণের পর জগতে ফুস্স বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তখন বোধিসত্ত্ব বিজিতাবী নামে ক্ষত্রিয় ছিলেন। তিনি মহারাজ্য পরিত্যাগ করে বুদ্ধের কাছে প্রব্রজিত হয়েছিলেন। জগতের শ্রেষ্ঠ নায়ক ফুস্স বুদ্ধও এই হতে বিরানব্বই কল্প পরে ‘ইনি বুদ্ধ হবেন’ বলে তাঁকে প্রকাশ করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব ফুস্স বুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করে দশটি পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন। সূত্রান্ত ও বিনয়াদি নবাঙ্গ বুদ্ধশাসন পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা করে জিনশাসন পরিশোভিত করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব সেই বুদ্ধশাসনে অপ্রমত্তভাবে অবস্থান করে ব্রহ্মবিহার ভাবনার দ্বারা পঞ্চ অভিজ্ঞা লাভ করে ব্রহ্মলোকগামী হয়েছিলেন।—বুদ্ধবংশ
বিপস্সী বুদ্ধ : ফুস্স বুদ্ধ পরিনির্বাণের পর জগতে বিপস্সী বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব মহাঋদ্ধিসম্পন্ন, পুণ্যবান ও জ্যোতিষ্মান অতুল নামে নাগরাজ হয়েছিলেন। সে সময় তিনি অনেক কোটি নাগ-পরিবৃত হয়ে দিব্যতূর্য নিনাদ করতে করতে লোকজ্যেষ্ঠ বুদ্ধের কাছে গিয়ে ধর্মরাজকে নিমন্ত্রণ করে মণিমুক্তারত্ন-খচিত, সর্বালংকারে ভূষিত, সোনার পাত দান করেছিলেন। সেই বিপস্সী বুদ্ধ সংঘমধ্যে বসে তাঁকে বলেছিলেন, ‘এই নাগরাজ একানব্বই কল্প পরে বুদ্ধ হবেন।’
বোধিসত্ত্ব বিপস্সী বুদ্ধের অব্যর্থ বাণী শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করেছিলেন এবং দশটি পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
সিখী বুদ্ধ : সে সময় তিনি অরিন্দম নামে ক্ষত্রিয় নরপতি হয়েছিলেন; সম্বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে মধুর অন্নপানীয় দানে পরিতৃপ্ত করেছিলেন। তিনি আরও অমূল্য শ্রেষ্ঠ বস্ত্র দান দিয়ে, অলংকৃত হাতির গাড়ি দান দিয়ে সম্বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। হাতির গাড়ি নির্মাণ করে কপ্পিয় বস্তু পূর্ণ করে পূজা করেছিলেন এবং তাঁর নিত্য দৃঢ়ভাবে উৎপন্ন দানচেতনা পূর্ণ করেছিলেন। জগতে অগ্রণী নায়ক সিখী বুদ্ধ—‘এই হতে একত্রিশ কল্প পরে বুদ্ধ হবেন’ বলে তাঁকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
তিনি সিখী বুদ্ধের অব্যর্থ বাণী শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করেছিলেন এবং দশটি পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
বেস্সভূ বুদ্ধ : সিখী সম্যকসম্বুদ্ধের শাসন বিলুপ্ত হওয়ার পরে তখনকার মানুষের আয়ু সত্তর হাজার বছর থেকে ক্রমান্বয়ে কমে দশ বছর হলো। এরপর আবার বেড়ে অসংখ্য বছর হলো। আবার কমতে কমতে ষাট হাজার বছর আয়ু হলে তখন বেস্সভূ বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হলেন।
এ সময় গৌতম বোধিসত্ত্ব সরভবতী নগরে সুদর্শন নামে রাজা হয়েছিলেন। বেস্সভূ লোকনায়ক সরভ নগরে পৌঁছালে তাঁর ধর্মদেশনা শুনে প্রসন্নমনে মনোরম সমুজ্জ্বল দশটি নখসম্পন্ন, পদ্মমুকুলের মতো আঙুলগুলো অঞ্জলিবদ্ধ করে মাথায় ঠেকিয়ে তিনি বুদ্ধসহ ভিক্ষুসংঘকে মহাদান দিয়েছিলেন। এরপর সেখানেই ভগবানের থাকার জন্য গন্ধকুটির নির্মাণ করে দিয়ে তার চারপাশে হাজার বিহার নির্মাণ করিয়েছিলেন। এরপর সব ধনদৌলত ভগবানের শাসনে দান দিয়ে তাঁর কাছে প্রব্রজিত হয়ে আচারগুণসম্পন্ন তেরোটি ধুতাঙ্গগুণে নিরত থেকে বোধিসম্ভার পূরণ করেছিলেন। সেই ভগবানও তাঁকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে এখন থেকে একত্রিশ কল্প পরে তিনি গৌতম নামে বুদ্ধ হবেন।’
বোধিসত্ত্ব বেস্সভূ বুদ্ধের কথা শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করেছিলেন এবং দশটি পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
ককুসন্ধ বুদ্ধ : ককুসন্ধ বুদ্ধকে গৌতম বোধিসত্ত্ব পাত্রচীবর, অঞ্জন ও মধুযষ্টি ইত্যাদি উত্তম উত্তম সব প্রার্থিত বস্তু দান করেছিলেন। বিনায়ক ককুসন্ধ মুনিও ‘ইনি এই ভদ্রকল্পে বুদ্ধ হবেন’ বলে তাঁকে অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব ককুসন্ধ বুদ্ধের কথা শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করে দশ পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
কোনাগমন বুদ্ধ : ককুসন্ধ বুদ্ধ পরিনির্বাণের পর জগতে কোনাগমন বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তখন গৌতম বোধিসত্ত্ব মিত্র-মন্ত্রীগণাদির দ্বারা পরিবৃত অনন্ত-বলবাহনযুক্ত পর্বত নামে ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন। বুদ্ধদর্শনের জন্য গিয়ে অনুত্তর ধর্ম শুনেছিলেন এবং নিমন্ত্রণ করে বুদ্ধসহ ভিক্ষুসংঘকে যথা ইচ্ছা দান দিয়েছিলেন। পত্তুর্ণ বস্ত্র, চীন বস্ত্র, পট্টবস্ত্র, পশমি কম্বল এবং সোনার জুতো বুদ্ধের শিষ্যদের দান করেছিলেন। সেই কোনাগমন মুনি ভিক্ষুসংঘের মধ্যে বসে—‘ইনি এই ভদ্রকল্পে বুদ্ধ হবেন’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী ব্যক্ত করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব কোনাগমন বুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করে দশটি পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
কাশ্যপ বুদ্ধ : কোনাগমন বুদ্ধ পরিনির্বাণের পর জগতে কাশ্যপ বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। বোধিসত্ত্ব তখন অধ্যাপক, মন্ত্রধারী, ত্রিবেদ পারদর্শী, মহাপুরুষলক্ষণ, ইতিহাস শাস্ত্র, স্বকীয় ব্রাহ্মণধর্ম, ভূতত্ত্ব ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে সুনিপুণ কৃতবিদ্য জ্যোতিঃপাল ব্রাহ্মণ নামে বিখ্যাত ছিলেন। বুদ্ধগৌরবকারী বিনীত ও অনাগামীফল প্রাপ্ত ঘটীকার নামে ব্যক্তি কাশ্যপ বুদ্ধের সেবক ছিলেন। ঘটীকার তাঁকে সঙ্গে নিয়ে কাশ্যপ বুদ্ধের কাছে গিয়েছিলেন। বুদ্ধের ধর্মকথা শুনে তিনি বেধিত্ত্বের কাছে প্রব্রজিত হয়েছিলেন। তখন তিনি আরব্ধবীর্য ছোটো-বড়ো ব্রত সম্পাদনে সুদক্ষ ছিলেন। শীল, সমাধি ইত্যাদি কোনোটির ছোটো-বড়ো পরিহানি না করে জিনশাসন পূর্ণ করতেন। বুদ্ধভাষিত নবাঙ্গ বুদ্ধশাসন যে পর্যন্ত ছিল, সেগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করে জিনশাসন পরিশোভিত করেছিলেন। সেই কাশ্যপ বুদ্ধও বোধিসত্ত্বের আশ্চর্য কর্মকুশলতা এবং অসাধারণ প্রতিপত্তি দেখে—‘ইনি এই ভদ্রকল্পে বুদ্ধ হবেন’ বলে প্রকাশ করেছিলেন।
বোধিসত্ত্ব কাশ্যপ বুদ্ধের কথা শুনে বিশেষভাবে চিত্ত প্রসন্ন করে দশটি পারমী পূরণের জন্য অধিকভাবে ব্রত অধিষ্ঠান করেছিলেন।—বুদ্ধবংশ
গৌতম বুদ্ধ এভাবে বোধিসত্ত্ব বা বুদ্ধাঙ্কুররূপে এই চব্বিশজন বুদ্ধের সাক্ষাৎ ও ভবিষ্যদ্বাণী লাভ করেছিলেন।
পারমীসম্ভার পূরণ
এভাবে পারমীগুণ পূরণে তাঁর সেই সুদীর্ঘকালব্যাপী অভিযানের মধ্যে দানপারমী পরিপূরণ করতে গিয়ে তিনি যা করেছেন তার তুলনা নেই। যেমন—অকীর্তি ব্রাহ্মণকালে, শঙ্খ ব্রাহ্মণকালে, তেমনিভাবে ধনঞ্জয় রাজা, মহাসুদর্শন, মহাগোবিন্দ, নিমি রাজা, চন্দ্রকুমার, বিসয়হ শ্রেষ্ঠী, শিবি রাজা ও বিশ্বন্তর জন্মে দানের যে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তার পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
এভাবে তিনি বহু জন্মে দানপারমী পূরণের জন্য নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করে দান-উপপারমী পূরণ করেছেন। বিভিন্ন জন্মে বহুবার নিজের জীবন বা আত্মদানের দ্বারা তিনি দানের পরমার্থপারমী পূর্ণ করেছিলেন।
তেমনিভাবে শীলবান নাগরাজ, চম্পেয়্য নাগরাজ ও ভূরিদত্ত নাগরাজরূপে, ছদ্দন্ত হাতি হয়ে, জয়দ্দিশ রাজপুত্ররূপে, অলীনশত্রুকুমার রূপে শীলপারমী পরিপূরণ করতে গিয়ে তিনি যে যন্ত্রণা সহ্য করেছেন তার তুলনা নেই। এভাবে তিনি মৃত্যুসম যন্ত্রণা সহ্য করে শীলের পরমার্থপারমী পূর্ণ করেছিলেন।
তেমনিভাবে সৌমনস্য কুমার, হাতিপাল কুমার ও অয়োঘর পণ্ডিতকালে বিশাল রাজত্ব পরিত্যাগ করে নৈষ্ক্রম্যপারমী পরিপূরণ করতে গিয়ে তিনি ত্যাগের যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, তা অতুলনীয়। এভাবে তিনি জন্মজন্মান্তরে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে বহুবার রাজ্যত্যাগ করে বৈরাগ্যের পরমার্থপারমী পূর্ণ করেছেন।
তেমনিভাবে বিধুর পণ্ডিত, কুদ্দাল পণ্ডিত, অরক পণ্ডিত, বোধিপরিব্রাজক ও মহৌষধ পণ্ডিতরূপে প্রজ্ঞাপারমী পরিপূরণের জন্য যা করেছেন জগতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। থলের মধ্যে ঢুকে থাকা সাপকে দেখিয়ে যেমন তিনি প্রজ্ঞার পরমার্থপারমী পূর্ণ করেছিলেন।
তেমনিভাবে বীর্যপারমী ইত্যাদি পরিপূরণ করতে গিয়েও তিনি যা করেছেন তার তুলনা নেই। মহাসমুদ্র উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বীর্যের পরমার্থ প্রাপ্ত হয়েছেন।
ক্ষান্তিবাদী জাতকে তিনি চৈতন্যহীন জড় পদার্থের মতো মহাযন্ত্রণা সহ্য করে ক্ষান্তির পরমার্থ প্রাপ্ত হয়েছেন। মহাসুতসোম জন্মে তিনি জীবনের বিনিময়ে সত্যরক্ষা করে সত্যের পরমার্থপারমী পূর্ণ করেছেন। জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে তিনি ব্রত অধিষ্ঠানের দ্বারা পরমার্থ অধিষ্ঠানপারমী পূর্ণ করেছেন।
একরাজ জাতকে তিনি জীবনের প্রতিও ভ্রূক্ষেপ না করে সবার প্রতি মৈত্রীপরায়ণ থেকে মৈত্রীর পরমার্থপারমী পূর্ণ করেছেন।
লোমহংস জাতকে গ্রামের দুষ্ট ছেলের দল তাঁর দেহে মলমূত্র নিক্ষেপ করলেও, অথবা পরবর্তীকালে তাঁর ওপর সুগন্ধি ফুল-মালাদি বর্ষিত হলেও সুখে কিংবা দুঃখে তিনি উপেক্ষা (মধ্যস্থ) ভাবের ব্যতিক্রম না করে উপেক্ষা পরমার্থপারমী পূর্ণ করেছেন।
এভাবে চার লাখেরও অধিক অসংখ্য কল্পের মধ্যে উৎপন্ন চব্বিশজন বুদ্ধের কাছ থেকে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে ত্রিশ পারমী পূরণ ও পঞ্চ মহাত্যাগ সম্পন্ন করে তিনি যাবতীয় বোধিসম্ভার পূরণ করেন। এই অসংখ্য কল্পের মধ্যে তিনি (গৌতম বোধিসত্ত্ব) মহাসম্মত রাজা, সুদর্শন মহাসম্মত রাজা, মখাদেব রাজা, নেমি রাজা, তেমিয় কুমার রাজা, শিবি রাজা, চন্দ্র কুমার, মহাগোবিন্দ, অকীর্তি ব্রাহ্মণ, শঙ্খ ব্রাহ্মণ, ধনঞ্জয়, শশরাজ, শীলবনাগ, (হস্তিনাগ), ভূরিদত্ত ব্রাহ্মণ, চম্পেয় ব্রাহ্মণ, চুলবোধি, মহিংস, করুমৃগ, মাতঙ্গ, ধর্মধ্বজ, শঙ্খপাল, যুধজয়, সৌমদত্ত, অয়োঘর, কপিরাজ, বর্তশাবক, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, মহাসুতসোম, সুবর্ণশ্যাম, একরাজ ও মহালোম হংস প্রভৃতি বহু জন্ম ধারণ করার পর অন্তিম জন্মে (বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বের জন্মে) জেতুত্তর রাজ্যে রাজা সঞ্জয়ের পুত্ররূপে বিশ্বন্তর নামে জন্মগ্রহণ করেন। সেই জন্মে তিনি রাজ্যের মঙ্গল হাতি দান করলে স্ত্রী-পুত্রকন্যাসহ বঙ্কুগিরিতে নির্বাসিত হয়েছিলেন এবং সেখানে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা দানান্তে দানপারমী পূরণ করেছিলেন। এরপর পুনরায় রাজ্যাভিষিক্ত হয়ে মরণের পর তুষিত স্বর্গে সন্তোষিত দেবপুত্র রূপে দেবলোকে উৎপন্ন হয়েছিলেন।
তিনি সেখানে দেবলোকের গণনায় চার হাজার বছর এবং মনুষ্যলোকের গণনায় সাতান্ন কোটি ষাট লাখ বছর ধরে বিপুল দিব্যসুখ পরিভোগ করেছিলেন।—চরিয়াপিটক
Leave a Reply