শ্রাবণী পূর্ণিমা’র তাৎপর্য
জ্ঞান অন্বেষণ ডেক্সঃ- তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের ৩ মাস পরে মগধরাজ অজাতাশত্র“র পৃষ্ঠপোষকতায় অরহত মহাকশ্যপ স্থবিরের সভাপতিত্বে রাজগৃহের বেভার পর্বতের সপ্তপর্ণী গুহায় ৫০০শত অহরত ভিক্ষু উপস্থিতিতে প্রথম বৌদ্ধ সংগীতি বা ভিক্ষু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই শ্রাবণী পূর্ণিমায় তিথিতে। তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের এত অল্প সময়ে কেন সম্মেলন আহ্বান করা হল অরহত মহাকশ্যপ এর বর্ণনায় আমরা সহজেই বুঝে নিতে পারি।
কুশীনারায় মল্ল রাজাদের যুগ্ম শাল বৃক্ষ তলে তথাগত বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণে নিবৃত্ত হলে মল্লরাজ ও অমাত্যবৃন্দ ভিক্ষুসংঘের অনুমতিক্রমে ভগবানের দেহ সূক্ষ্ম নতুজ বস্ত্রদ্বারা আবেষ্টন করত তৎপর সুধুনিত কার্পাস দ্বারা ৫০০ যুগবার বেষ্টন করে স্বর্ণময় তৈলপূর্ণ পাত্রে স্থাপন করতঃ নানাবিধ সুগন্ধি দ্রব্য দ্বারা পূর্ণ করে অপর স্বর্ণময় পাত্র দ্বারা আবৃত করলেন। অতপরঃ উত্তর দক্ষিণ ১২০ হাত পূর্ব পশ্চিম ১২০ হাত শ্মশান রচনা করতঃ মল্লা রাজাদের নগরের পূর্ব পার্শ্বে বন্ধন নামক মঙ্গলশালায় তৈলপূর্ণ স্বর্ণময় চিতার উপর ভগবানের দেহ আরোপিত করলেন।
সেই সময়ে ভগবান বুদ্ধের অশীতি মহাশ্রাবক অরহত মহাকশ্যপ তাঁর ৫০০ জন ভিক্ষু সংঘ সহ পাবা নগর হতে কুশীনারার দিকে আসছিলেন। পথিমধ্যে তিনি এক বৃক্ষমূলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তেমন সময়ে আজীবক সম্প্রদায় ভূক্ত এক সন্ন্যাসী রৌদ্রের তাপ নিবারণার্থে এক দিব্য মন্দার পুষ্প মাথায় উপর ধরে সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। অরহত মহাকশ্যপ জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন যে, সপ্তাহ খানেক আগে শ্রামণ গৌতম পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হয়েছেন। সেই পরিনির্বাণ স্থানে অনেক স্বর্গীয় পুষ্প পতিত হয়েছে। এই মন্দার পুষ্প সেখান থেকে সংগৃহীত। অরহত মহাকশ্যপ ধ্যানস্থ হয়ে তথাগতের পরিনির্বাণ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হলেন।
তথাগতের পরিনিবার্ণ সংবাদ শুনার সঙ্গে সঙ্গে তার সাথে থাকা আরও ৫০০ জন ভিক্ষু যারা অনেকেই বুদ্ধকে দেখেনি তাঁরা শোকাবেগ সংবরণ করতে না পেরে কেউ বুক চাপরিয়ে, কেউ মাথায় হাত দিয়ে, কেউ কেউ ছিন্নবৎ ভূতলে পতিত হয়ে ইতস্ততঃ এই বলে ক্রন্দন করছিলেন যে, অতিশীঘ্রই ভগবান নির্বাপিত হলেন। অতিশীঘ্রই চক্ষুস্মান পৃথিবী হতে অন্তর্হিত হবেন।
সেই ভিক্ষুদের মধ্যে বৃদ্ধকালে প্রব্রাজিত সুভদ্র নামে একজন ভিক্ষু ছিলেন। তিনি শোকাহত ভিক্ষগণকে বললেন তোমরা শোক করিও না। বিলাপও করিও না। আমরা এখন সেই মহাশ্রামন হতে মুক্তি পেয়েছি। তিনি সবসময় আমাদেরকে শাসন করতেন। ইহা তোমাদের উপযুক্ত, ইহা অনুপযুক্ত, ইহা করতে পারবে, ইহা করতে পারবে না ইত্যাদি বাক্যবানে এতদিন আমরা জর্জরিত ছিলাম। এখন আমরা যা ইচ্ছা তা করতে পারব। মহাকশ্যপ ভিক্ষুদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন বন্ধুগণ তথাগত বুদ্ধ সুভদ্রের উক্তিতে হৃদয়ে বড়ই ব্যাথা পাইলেন। মাথায় ব্জ্র পতনের ন্যায় বোধ হইল। ভগবান পরিনিবার্ণ হয়েছেন মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে। এখন ও তার সুবর্ণময় দেহ ধরণীপৃষ্টে বিদ্যমান। ভগবান কর্তৃক অতি কষ্ঠে স্থাপিত এই শাসনে কোন পাপ ময়লা উৎপন্ন হতে দেওয়া যাবে না। এই পাক বর্ধিত হয়ে আরও পাপ সহায় বৃদ্ধি পাইলে শাসন বিনষ্ট হবে। তাঁর সমস্ত শাসন তিন বার আমার উপর ন্যাস্ত করেছিলেন সুতরাং আমি বেঁচে থাকতে অধর্ম ও অবিনয়বাদীর বিস্তার না ঘটতেই অবশ্যই এই ধর্ম বিনয় সংগ্রহ এবং ভিক্ষু সম্মেলন করব। তবে বিষয়টি তিনি আপাতত গোপন রাখলেন।
অতঃপর মহাকশ্যপ স্থবির তিনি সশিষ্য কুশীনারার দিকে অগ্রসর হলেন। ঐ সময় মল্লরাজের মধ্যে ৪ জন প্রধান মল্ল নতুন বস্ত্র পরিধান করে ভগবানের চিতায় বার বার চেষ্টা করেও অগ্নিসংযোগ করতে ব্যর্থ হলেন। অরহত অনুরুদ্ধ স্থবিরকে এর কারণ ও হেতু জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে, যতক্ষন অরহত মহাকশ্যপ স্থবির তাঁর শিষ্য সহ এসে ভগবানের চরণ বন্দনা না করবেন ততক্ষণ চিতায় আগুন প্রজ্জলিত হবে না। তিনি এখন কুশীনারার পথে রয়েছেন। সবাই আশ্চর্য্য হয়ে চেয়ে রইলেন তিনি কেমন ভিক্ষু, যিনি এসে ভগবানের চরণ বন্দনা না নিবেদন করলে চিতা জ্বলবে না। সকলে উদ্গ্রীব হয়ে তাঁর পথপাণে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর অরহত মহাকশ্যপ চিতার স্থলে এসে চতুর্থ ধ্যান মগ্ন হয়ে অধিষ্ঠান করলেন, তথাগতের পাদদ্বয় আমার মস্তকে এসে স্থিত হোক অধিষ্ঠান সঙ্গে সঙ্গে মহাকারুণিক বুদ্ধের সুবর্ণ বর্ণ পাদদ্বয় স্বর্ণময় তৈল পূর্ণাধার চন্দন চিতা ভেদ করে মহাকশ্যপের কপালে স্থিত হল। তিনি ভগবানের পাদদ্বয় জড়িয়ে ধরে মস্তকে স্থাপন করলেন। উপস্থিত জনতা এই আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখে মহাধ্বনি দিতে লাগলেন, তারপর সেই ৫০০ ভিক্ষু যাঁরা আগে অনেকেই বুদ্ধকে দেখেননি তারা ও বুদ্ধের পাদদ্বয় বন্দনা করলেন। বন্দনা করা শেষ হলে ভগবানের চিতা আপনা আপনি জ্বলে উঠল। অতঃপর দাহক্রিয়া শেষ হলে অরহত মহাকশ্যপ সেখান উপস্থিত ৭ লক্ষ ভিক্ষুর সামনে সুভদ্রের অন্যায় উক্তির কথা প্রকাশ করলেন।
উপস্থিত ভিক্ষুগন সুভদ্রের ভাষিত উক্তি শুনে ভীষণভাবে মর্মাহত হলেন। অরহত মহাকশ্যপ ধর্ম বিনয় পরিশুদ্ধ করার প্রস্তাব করলে সকলে তা সমর্থন করেন। উপস্থিত ভিক্ষুগণের অনুরোধে অরহত মহাকশ্যপ বুদ্ধ প্রশংসিত ত্রিপিটক বিশারদ ধর্ম বিনয়ে গভীর জ্ঞানে প্রদিসম্বিদাপ্রাপ্ত এরূপ ৫০০ অহরত ভিক্ষু নির্বাচন করলেন। আনন্দ তখনও অরহত হতে পারেননি তাঁর নাম উল্লেখ করলেন না, ভদন্ত আনন্দের নাম তালিকা অন্তভূর্ক্ত করার জন্য উপস্থিত ভিক্ষুসংঘ বিনীতভাবে অনুরোধ জানালে অরহত মহাকশ্যপ তাঁকেও তালিকাভূক্ত করলেন। মগধরাজ অজাতশত্র“র সাথে মহাকশ্যপ স্থবির আলাপ করে স্থান টিক করলেন। সপ্তপনী গুহাদ্বারে পঞ্চশত ধর্মমন্ডপ প্রস্তুত করলেন। দক্ষিণ দিকে উত্তরমুখী করে স্থবিরগণের আসন সুসজ্জিত করলেন। মন্ডপের পূর্বমুখী করে ভগবানের আসন তুল্য ধর্মাসন নির্মাণ করে দন্ডখচিত ব্যজনী স্থাপন পূর্বক দেবতুল্য চমৎকার এক মন্ডপ তৈরী করলেন।
৮
ভদন্ত আনন্দ স্থবিরের অরহত্ব প্রাপ্তি ও সম্মেলনে যোগদানঃ
শ্রাবণী পুর্ণিমার পূর্বদিন ভিক্ষু সংঘ আনন্দ স্থবিরকে উৎসাহ দিতে লাগলেন। অরহত না হয়ে সম্মেলনে যোগদান করা আপনার উচিত হবে কি? আমাদের অনুরোধে আপনাকে তালিকাভুক্ত করেছেন কিন্তু বীর্যবানের পক্ষে ইহা শোভনীয় নয়। ধর্ম ভান্ডারাধ্যক্ষ হিসাবে খ্যাত, তথাগথের সঙ্গে ছায়ার মত বিচরণকারী ধর্ম বিনয়ে পন্ডিত আনন্দ লজ্জায় ক্ষোভে এই রাত্রির মধ্যেই অরহত্ব ফল প্রাপ্ত হওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন। আনন্দ ভাবলেন আমাকে অরহত হতে হবে এবং অরহত হয়েই সম্মেলনে যোগদান করতে হবে। সমস্ত রাত্রি তিনি তাঁর মনের শক্তি দিয়ে কায়গত স্মৃতি ভাবনায় রত হলেন। সারারাত্রি অবিশ্রান্ত কঠোর সাধনা করে বিনিদ্র রজনী যাপন করলেন কিন্তু তৃষ্ণামক্ত হতে পারেননি। বার বার বুদ্ধের কথা স্মরণ করছেন, বুদ্ধ বলেছিলেন অচিরেই তুমি তৃষ্ণামুক্ত হবে। বুদ্ধবাণী মিথ্যা হতে পারে না। হতাশায় ও বেদনায় ক্লান্ত দেহ শয়ন উদ্দেশ্য ভূমিতল গদহতে পদতল উঠাচ্ছের, হেলে পড়ছেন মাথা রাখার ইচ্ছায়। ঠিক সেই সময় তাঁর চিত্ত তৃষ্ণামুক্ত হল। তিনি অরহত্ব ফল লাভ করলেন এবং সম্মেলন আরম্ভের একটু আগে তারজন্য রক্ষিত আসনে মাটি বেদ করে উপবিষ্ট হলেন। উপস্থিত সকলেই বুঝলেন যে, আনন্দ বীর্যবানের পরিচয় দিয়েছেন এবং ভিক্ষুর করণীয় কাজ শেষ করেছেন। যথাসময়ে অরহত মহাকশ্যপের সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হল। সভাপতির আসনে বসে প্রথম বুদ্ধ শাসনের আয়ু বিনয় বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য বিনয়ধর উপালী স্থবিরকে আহ্বান জানালেন। উপালী স্থবির ধর্মাসনে বসে বিনয় আবৃত্তি করেন পরে ৫০০ জন অরহত ভিক্ষু একই নিয়মে বিনয়ের সমস্ত বিষয় আবৃত্তি করলেন। পূর্বোক্তি নিয়মে আনন্দ স্থবির ধর্মাসনে বসলেন। অরহত মহাকশ্যপ তাকে সূত্র ও অভিধর্ম বিষয়ে প্রশ্ন করলেন অরহত আনন্দ স্থবির উত্তর প্রদান করেন। সেই উত্তর যথাযথ হচ্ছে কিনা উপস্থিত ভিক্ষুরা তা পর্যালোচনা করেন। এইভাবে ৫০০ শত অরহত দ্বারা প্রথম সঙ্গীতির কার্য্য সু-সম্পাদিত হয়েছিল বলে ইহা পঞ্চশতিকা সঙ্গীতি নামে অভিহিত। চারমাস ধরে এই সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অরহতগণের আবৃত্তি পরম্পরা চলে আসছিল, অরহতগণের এতই স্মৃতিবহুল ছিলেন যে তাদের কোনন বই পুস্তকের প্রয়োজন ছিল না, কাজের সেই সময় ত্রিপিটক গ্রন্থ লিপিবদ্ধ হয় নি।
আজ সেই মহান শ্রাবণি পূর্ণিমা এই দিনে সকল বৌদ্ধ ধর্মালম্বী দান-শীল-ভাবনারত থেকে পূর্ণ রাশি অর্জন করা একান্ত কর্তব্য। সকলের মৈত্রী জ্ঞান উৎপন্ন হোক।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক
Leave a Reply