৩৭ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্মের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা-(পর্ব- ১৩)
লিখছেন সুলেখা বড়ুয়াঃ- ধর্মঃ ধর্মের স্বভাব পাঁচ প্রকার। যথা—
ক) চতুরার্য সত্য, খ)পঞ্চস্কন্ধ, গ) পঞ্চ নীবরন, ঘ) ষড়ায়তন, ও ঙ) সপ্ত বোধ্যঙ্গ ।
আজকের আলোচনা ঘ) “ষড়ায়তন”-চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ,জিহ্বা, কায় ও মন।
বুদ্ধের ভাষায় ষড়ায়তনঃ-
‘আয়তন’ অর্থ উৎপত্তি স্হান, নিবাস স্হান।
আয়তন দুই প্রকার।১) ছয় আধ্যাত্মিক আয়তন এবং ২) ছয় বাহ্যিক আয়তন।
চক্ষু ও রূপ— দ্বার ও আলম্বনের আকারে ,চক্ষু -বিজ্ঞানের আয়তন বা উৎপত্তি স্হান।
শ্রোত্র ও শব্দ—শ্রোত্র বিজ্ঞানের আয়তন বা উৎপত্তি স্হান। ঘ্রাণ ও গন্ধ—ঘ্রাণ বিজ্ঞানের আয়তন বা উৎপত্তি স্হান। জিহ্বা ও রস—জিহ্বা বিজ্ঞানের আয়তন বা উৎপত্তি স্হান।
কায় (শরীর) ও স্প্রষ্টব্য (স্পর্শযোগ্য বস্তু) — কায় বিজ্ঞানের আয়তন বা উৎপত্তি স্হান।
এবং মন ও ধর্ম—মনো বিজ্ঞানের আয়তন বা উৎপত্তি স্হান।
আভ্যন্তরিকঃ
চক্ষু পঞ্চবিধঃ যথা – বুদ্ধচক্ষু, ধর্মচক্ষু, দিব্যচক্ষু, মাংসচক্ষু ও সমন্তচক্ষু। এখানে চক্ষু বলতে মাংস চক্ষুর প্রসাদ অংশকে বুঝাচ্ছে। প্রসাদ অর্থ স্বচ্ছতা। স্বচ্ছ দর্পনে যেমন পদার্থের প্রতিবিম্ব পড়ে, তেমনি এই প্রসাদরূপের অন্তর্গত চক্ষে বর্ণের, শ্রোত্রে শব্দের, ঘ্রাণে (নাসিকায়) গন্ধের, জিহ্বায় রসের, কায়ায় (দেহে) স্প্রষ্টব্যের (ত্বগিন্দ্রিয় গ্রাহ্য জড় – গুণের) যেন প্রতিবিম্ব পতন দ্বারা স্পর্শোৎপত্তি হয়।
লিখক সুলেখা বড়ুয়া বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রবন্ধকার, ছড়াকার ও গবেষণাধর্মী বাস্তব’বাদী লিখিকা। তিনি দূর প্রবাসে অবস্থান করেও তার লেখনী ও অন্য অন্য কর্মের মাধ্যমে শাসন ধর্মের কল্যানে অনবদ্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। আমি তার মঙ্গল ময় জীবন কামনা করছি– স্থবির এম ধর্মবোধি ভান্তে।
চক্ষু দুঃখ, যা দুঃখ তা অনাত্ম; যা অনাত্ম তা আমার নয়, তা আমি নই; তা আমার নয়, এরূপে সম্যক প্রজ্ঞার দ্বারা বিষয়টি যথাযথভাবে দর্শন করা উচিত।
শ্রোত্র দুঃখ, যা দুঃখ তা অনাত্ম; যা অনাত্ম তা আমার নয়, তা আমি নই; তা আমার নয়, এরূপে সম্যক প্রজ্ঞার দ্বারা বিষয়টি যথাযথভাবে দর্শন করা উচিত।
ঘ্রাণ দুঃখ, যা দুঃখ তা অনাত্ম; যা অনাত্ম তা আমার নয়, তা আমি নই; তা আমার নয়, এরূপে সম্যক প্রজ্ঞার দ্বারা বিষয়টি যথাযথভাবে দর্শন করা উচিত।
জিহ্বা দুঃখ, যা দুঃখ তা অনাত্ম; যা অনাত্ম তা আমার নয়, তা আমি নই; তা আমার নয়, এরূপে সম্যক প্রজ্ঞার দ্বারা বিষয়টি যথাযথভাবে দর্শন করা উচিত।
কায় দুঃখ, যা দুঃখ তা অনাত্ম; যা অনাত্ম তা আমার নয়, তা আমি নই; তা আমার নয়, এরূপে সম্যক প্রজ্ঞার দ্বারা বিষয়টি যথাযথভাবে দর্শন করা উচিত।
মন দুঃখ, যা দুঃখ তা অনাত্ম; যা অনাত্ম তা আমার নয়, তা আমি নই; তা আমার নয়, এরূপে সম্যক প্রজ্ঞার দ্বারা বিষয়টি যথাযথভাবে দর্শন করা উচিত।
উক্ত বিষয়গুলো এভাবে দর্শন করে চক্ষুতে নির্বেদ প্রাপ্ত ( নির্লিপ্ত) হন, শ্রোত্র নির্বেদ প্রাপ্ত হন, ঘ্রাণ নির্বেদ প্রাপ্ত হন, জিহ্বায় নির্বেদ প্রাপ্ত হন, কায়ে নির্বেদ প্রাপ্ত হন ও মনে নির্বেদ প্রাপ্ত হন। নির্বেদ প্রাপ্ত হয়ে বিরাগ হন, বিরাগ হতে বিমুক্ত হন।
এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অবস্হান কালে ভিক্ষুগণকে বললেন্, ‘হে ভিক্ষুগণ, আমি সম্বোধি লাভের পূর্বে অনভিসম্বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব অবস্হায় আমার মনে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছিল,
—চক্ষুর আস্বাদ কি, দোষ কি, নিঃসরণই বা কি?(মুক্তি)
—শ্রোত্রের আস্বাদ কি, দোষ কি, নিঃসরণই বা কি?
—ঘ্রাণের আস্বাদ কি, দোষ কি, নিঃসরণই বা কি?
—জিহ্বার আস্বাদ কি, দোষ কি, নিঃসরণই বা কি?
—কায়ের আস্বাদ কি, দোষ কি, নিঃসরণই বা কি?
—মনের আস্বাদ কি, দোষ কি, নিঃসরণই বা কি?
হে ভিক্ষুগণ, তখন আমার যথাযথ মনস্কারে প্রজ্ঞার উদয় হল— চক্ষু হেতু যে সুখ-সৌমনস্য উৎপন্ন হয় তাই চক্ষুর আস্বাদ। চক্ষু যে অনিত্য, দুঃখ: বিপরিণামধর্মী ( পরিবর্তনশীল) তা চক্ষুর দোষ। চক্ষুর প্রতি যে ছন্দরাগ (অনুরাগ) দমন, ছন্দরাগ পরিহার, তা চক্ষুর নিঃসরণ (মুক্তি)।
—শ্রোত্র হেতু যে সুখ-সৌমনস্য উৎপন্ন হয়, তা শ্রোত্রের আস্বাদ। শ্রোত্র যে অনিত্য, দুঃখ পরিবর্তনশীল ; তা শ্রোত্রের দোষ (আদীনব)। শ্রোত্রের প্রতি যে ছন্দরাগ দমন, অনুরাগ পরিহার তা শ্রোত্রের নিঃসরণ।
—ঘ্রাণ হতে যে সুখ-সৌমনস্য উৎপন্ন হয়, তা ঘ্রাণের আস্বাদ।ঘ্রাণ যে অনিত্য, দুঃখ, পরিবর্তনশীল ; তা ঘ্রাণের দোষ। ঘ্রাণের প্রতি যে অনুরাগ দমন, ছন্দরাগ পরিহার তা ঘ্রাণের নিঃসরণ।
—জিহ্বা হতে যে সুখ-সৌমনস্য উৎপন্ন হয়, তা জিহ্বার আস্বাদ। জিহ্বা যে অনিত্য, দুঃখ ও পরিবর্তনশীল ; তা জিহ্বার দোষ। জিহ্বার প্রতি যে অনুরাগ দমন, ছন্দরাগ পরিহার, তা জিহ্বার নিঃসরণ।
—কায় (দেহ) হেতু যে সুখ-সৌমনস্য উৎপন্ন হয়, তা কায়ের আস্বাদ। কায় যে অনিত্য, দুঃখ ও পরিবর্তনশীল; তা কায়ের দোষ। কায়ের প্রতি যে অনুরাগ দমন, অনুরাগ পরিহার, তা কায়ের নিঃসরণ।
—মন হেতু যে সুখ- সৌমনস্য উৎপন্ন হয়, তা মনের আস্বাদ। মন যে অনিত্য, দুঃখ ও পরিবর্তনশীল; তা মনের দোষ। মনের প্রতি যে অনুরাগ দমন, অনুরাগ পরিহার, তা মনের নিঃসরণ।
হে ভিক্ষুগণ, “যতদিন পর্যন্ত এভাবে এই ছয় আধ্যাত্মিক আয়তনের আস্বাদকে আস্বাদরূপে, দোষকে দোষরূপে ও নিঃসরণকে নিঃসরণরূপে যথাযথভাবে আমি বুঝতে পারিনি, ততদিন আমি সদেব সমার সব্রহ্ম জগতে সশ্রমণ- ব্রাহ্মণ ও দেব-মানবের মধ্যে অনুত্তর সম্যক সম্বোধি লাভ করেছি বলে প্রতিজ্ঞাত হয়নি। হে ভিক্ষুগণ, যখন আমি এই ছয় আধ্যাত্মিক আয়তনের আস্বাদকে আস্বাদরূপে, দোষকে দোষরূপে ও নিঃসরণকে নিঃসরণরূপে সম্যকভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছি, তখনই আমি সদেব সমার সব্রহ্ম জগতে সশ্রমণ- ব্রাহ্মণ ও দেব- মানবের মধ্যে অনুত্তর সম্যক সম্বোধি লাভ করেছি বলে প্রতিজ্ঞাত হয়েছিলাম এবং আমার জ্ঞানদৃষ্টির বিকাশ হয়েছিল।’আমার বিমুক্তি অকম্পিত, এই আমার অন্তিম জন্ম, এখন আমার পুনজন্মের সম্ভাবনা নেই।
উক্ত ষড়ায়তন এর কার্য- কারণ -নীতি সম্যক ভাবে বুঝতে সচেষ্ট থাকুক সবাই।
”চলমান থাকবে অবিরাম”
“চক্রবাল বাসী সুখী হউক”!
[বিঃদ্রঃ-৩৭ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্ম সহজ ভাষায় সংক্ষিপ্ত আকারে বোঝানোর জন্য এহেন প্রয়াস, বিভিন্ন বই এবং দেশনালব্দ জ্ঞানের সহযোগিতায়।]
সুখী হোন