অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শিক্ষা দেয় বৌদ্ধধর্ম
ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
বৌদ্ধধর্ম মূলতঃ যুদ্ধে পারদর্শী মূল নিবাসী ক্ষত্রিয়দের থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। রাজকুমার সিদ্ধার্থ যে শাক্যবংশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, সে শাক্যবংশের লোকেরা তিরন্দাজীতে অতীব নিপুণ লড়াকু ছিলেন। রাজকুমার সিদ্ধার্থও স্বীয় যুবা অবস্থায় প্রসিদ্ধ ধনুর্ধর ছিলেন এবং তাঁর সাথে মোকাবিলা করতেও কেহ সাহস করতেননা। তৎকালীন সময়ের অস্ত্র চালনা বিদ্যা, যুদ্ধ বিদ্যা ও কূটনীতি বিদ্যায় তিনি ছিলেন বিশেষ পারঙ্গম।
তথাগত বুদ্ধের সময় ক্ষত্রিয়দের মূল সমস্যা ছিল ব্রাহ্মণ্য পুরোহিতদের বৈচারিক দাদাগিরির সাথে। পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা ক্ষত্রিয়দেরকে ধর্মের মাধ্যমে অপমানিত করার অনেক উদাহরণ পালি বৌদ্ধ সাহিত্যে পাওয়া যায়। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দীর্ঘ নিকায়ের ‘অম্বট্ঠ সুত্র’, মধ্যম নিকায়ের ‘অস্সলায়ন সুত্র’ প্রভৃতি।
পুরোহিতদের বৈচারিক দাদাগিরি হতে ক্ষত্রিয় তথা মূলনিবাসীদেরকে মুক্ত করা সে সময় তথাগত বুদ্ধের প্রতিবাদের অন্যতম আন্দোলনের অংশ হয়েছিল। এজন্য তথাগত বুদ্ধ এবং বর্ধমান মহাবীরের মত রাজপুত্রগণ নিজেদের রাজ সিংহাসন ত্যাগ করে বৈচারিক ক্ষেত্রে পুরোহিতদের সাথে মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিজেদের জীবনে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের সিদ্ধান্তের পক্ষে তাঁদের পরিবার-পরিজন, ক্ষত্রিয়, ব্যবসায়ী সমাজ তথা অন্য বৃহৎ সমাজের মূল নিবাসীদের আন্তরিক সমর্থন ছিল। এজন্য বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির পর সবার আগে তথাগত বুদ্ধের মতাদর্শকে ক্ষত্রিয় মগধ নরেশ বিম্বিসার, ক্ষত্রিয় কোশল নরেশ প্রসেনজিত, ক্ষত্রিয় শাক্যরাজ শুদ্ধোদন এবং অন্যান্য শাক্যসঙ্ঘেরাও স্বাগত করেছিলেন। ক্ষত্রিয় কুল হতে অনেকে ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সঙ্ঘে সম্মিলিত হয়ে বুদ্ধের ধর্মাভিযানে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
কেবল তা নয়, তৎকালীন সময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিক ( সুদত্ত), ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠী, মিগার শ্রেষ্ঠী, ধনাঢ্য নারী বিশাখা, ব্যবসায়ী পুত্র যশ, লিচ্ছবি রাজাগণ এবং যশের সুহৃদদের মত হাজার হাজার ব্যবসায়ীগণ সামাজিক শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বুদ্ধের প্রতিবাদের অভিযানে ওতপ্রোতভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ব্যবসায়ীগণও পুরোহিত ব্রাহ্মণদের শোষণ মূলক অত্যাচার হতে বের হয়ে বুদ্ধের ন্যায়, বন্ধুত্ব ও সাম্যের আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন এবং তাঁরা উজাড় করে ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সঙ্ঘকে ধর্মাভিযানে আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন।
ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পুনরুত্থানের অগ্র নায়ক বোধিসত্ব বাবা সাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকর অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন যে, ‘অন্যায় সহ্য করতে থাকলে অন্যায় আরও বেড়ে যায়। অন্যায়কারীর চেয়েও অন্যায় সহ্যকারী অধিকতর অপরাধী হয়।’ তথাগত বুদ্ধেরও ছিল একই বিচার। এক মূল নিবাসী ব্যক্তি ছিলেন অতীব সাহসী ও আক্রমণাত্মক। তাঁকে সবাই ভয় করত। কিন্তু যখন হতে তিনি তথাগত বুদ্ধের অনুগামী হয়েছিলেন, সেসময় হতে তিনি নিজের ক্রোধ ও হিংসা ত্যাগ করেছিলেন। সম্পূর্ণরূপে তিনি অহিংসক হয়েছিলেন। তখন সকলে তাঁর উপর অন্যায় ও জুলুম করতে লাগলেন এবং তাঁরা তাঁর জীবনকে অস্থির করে তুলেছিলেন।
এতকিছুর পরেও সে মূল নিবাসী ব্যক্তি বুদ্ধের অহিংস বাণী স্মরণ করে যখন সবকিছু নীরবে সহ্য করছিলেন, তখন তাঁর উপর যে অন্যায় ও জুলুম হচ্ছে, তা দেখে বুদ্ধ তাঁকে ভৎর্সনা করতে লাগলেন এবং বললেন যে, আমার শিক্ষা কখনও এরূপ বলেনা যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেনা। আমার শিক্ষা ইহাই বলে থাকে যে, অন্যায়ভাবে কোন নির্দোষ ব্যক্তিকে দোষী করে কষ্ট দেবেনা এবং কারো সাথে হিংসাত্মক আচরণ করোনা। কিন্তু বিনা কারণে, বিনা দোষে যদি কেহ অত্যাচার করে, কষ্ট দেয় এবং যন্ত্রণা প্রদান করে তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। যুদ্ধ করার সম্পর্কে রাজা এবং সৈনিকদেরকেও বুদ্ধ সে উপদেশই দিয়েছেন। নিজের দেশের যান-মাল, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাজাদের যুদ্ধকেও বুদ্ধ সমর্থন করেছেন। তবে অন্যায়ভাবে যুদ্ধকে বুদ্ধ তিরস্কার করেছেন।
কিন্তু মধ্যযুগীয় ভারতে বুদ্ধের অহিংসা সিদ্ধান্তকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেকারণে বৌদ্ধেরা একেবারেই অহিংসাত্মক হয়ে যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন প্রকারের প্রতিবাদ করতেই ভুলে গিয়েছিল। সমস্ত অন্যায়-অত্যাচার নীরবে সহ্য করে গিয়েছে। যার ফলে তাঁরা নিজেদের শৌর্য-বীর্য হারিয়ে পশুত্ব জীবন-যাপনে বাধ্য হয়েছে। বৌদ্ধরা নিষ্প্রভ হয়ে ধ্বংস হয়েছে।
তথাগত বুদ্ধের ধর্ম ইহাই শিক্ষা দিয়ে থাকে যে, নিজের স্বাভিমান, অধিকার এবং নৈতিক মূল্যবোধের জন্য প্রয়োজনে লড়ে যেতে হবে। অন্যায়ের পক্ষে মাথা নত করা বুদ্ধের শিক্ষা নয়। বরং অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে সাহসের সাথে মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ করতে হবে।
আপনারা দেখতে পারেন। পৃথিবীতে ইউক্রেন হল এক ছোট্ট দেশ। কিন্তু সে দেশ নিজেদের কেবল স্বাভিমান ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই দোর্দণ্ড প্রতাপ অপরাশক্তি বিশাল রাশিয়ার সাথে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। স্বাভিমানী জীবন ও নিজের হক-অধিকার ভিক্ষা করে পাওয়া যায়না। তজ্জন্য লড়াই, সংঘর্ষ, আন্দোলন ও যুদ্ধ পর্যন্ত করতে হয়। বৌদ্ধধর্ম ইহাই শিক্ষা দিয়ে থাকে। এজন্যই বৌদ্ধধর্মকে বলা হয় ‘ক্ষাত্র ধর্ম।’ কেননা ইহা হল মূল নিবাসী ও ক্ষত্রিয়দের পরম্পরা হতে উদ্ভূত ধর্ম।
Leave a Reply