আমার দেখা আর শোনা মহাজীবনের কিছু গল্প :
ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের, আমেরিকা
বাংলাভাষী বৌদ্ধদের ধর্মীয় জীবনে প্রথম সংঘরাজ ধরা হয় মহাজীবন সারমিত্ তথা সারমেধ মহাথেরো কে। কথিত আছে তাঁর জন্ম উনবিংশ শতকে বৃটিশ শাসনামলে বর্তমান চকরিয়া উপজেলার হারবাং এলাকায়। রাখাইন পরিবিরের এই সন্তানটি শৈশবে প্রব্রজ্যা নিয়ে গুরুর সাথে অবস্থান করতেন আকিয়াবের গদুভাঙা নদীর মোহনায় অবস্থিত সংঘরাজ বিহারে(এখানে ভিক্ষুত্ব বরণ ও ধর্ম-বিনয় শিক্ষা করেছিলেন বড়ুয়ার মহাকীর্তিমান সন্তান পটিয়ার উনাইনপুরা গ্রামের চন্দ্রমোহন ঠাকুর আচারিয়া পূর্ণাচার)। কালে আপন প্রতিভার কর্ম আর দক্ষতায় সেই সারমিত্ শ্রামণটিও বৃটিশ শাসকগণের দ্বারা তৎ অন্চলের সংঘরাজ তথা সংঘপ্রধানের পদে অভিষিক্ত হন। সমাজ সংস্কার আর সদ্ধর্ম প্রচার প্রতিষ্ঠার অদম্য নেশায় তিনি পায়ে হেটে আকিয়াব থেকে একবার বুদ্ধের অন্তিম শয্যা দর্শনে কুশীনগর গেলেন।
কুশীনগর বলতে ১৮৬৪ খৃস্টাব্দে তখনকার দিনে কোথায় চিহৃিত করা হতো এই নিয়ে মতভেদ আছে। তারপরও আমার পাওয়া তথ্য মতে ( ধাঈয়াওয়াদি রাজোয়াইং) অর্থৎ ধন্যবতী রাজবংশ নামক আরকানের চন্দ্র সূর্য (চেঈন্দাসূরিয়া) রাজবংশের ইতিহাস গ্রন্থের বর্ণনা মতে জানা যায় আরকানীরা তখনকার কুশীনগর বলে চিহৃিত করে ছিলেন তাঁদের সামন্ত রাজ্য উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী(আট হাজারী সেনানিবাস রাজবাইজ্যা )বর্তমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন এলাকার নিকটবর্তী চন্দ্রনাথ পাহাড়শীর্ষে অবস্থিত সাধক চন্দ্রমুণি ভিক্ষুর অবস্থান স্থল চন্দ্রনাথ ধাম ; বর্তমান সীতাকুন্ডুতে। আমার শৈশবেও এইটি ছিল উত্তর চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের অন্যতম তীর্থ।
প্রতিবছর সেখানে মাঘীপূর্ণিমায় এই অন্চলের বৌদ্ধরা প্রয়াত প্রিয়জনদের “গদ্কুষ্টি ” নামক জীবন পন্জি টি উক্ত কুশীনগরে রেখে আসতেন। উড়িষ্যার বণিক তপস্সু-বল্লিক কে যেভাবে মায়ানমার য়াঙ্গুনে নিয়ে এসে বিশ্বখ্যাত সোয়েডাগঙ প্যাগোডার জন্ম দেয়া হয় ; এমন অনৈতিহাসিক ইতিহাস রচনা তৎকালীন দুর্গম যোগাযোগের কারণে পূথিবীর সব ইতিহাসেই হয়েছে। সেই যা ই হোক! আরকান সামন্তরাজ্যের তৎকালীন রাজধানী আমার জন্ম স্থান হাটহাজারীর জোবরা গ্রামেই।
এই এলাকায় এখনো আরকানীরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া গুপ্তধন তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা কালেভদ্রে ঘটে থাকে। সেই সুবাদে আমাদের শৈশব গোচারণ আর জ্বলানীকাঠ সংগ্রহ ভূমি প্রাণের রাজবাইজ্যার(রাজবাড়ী) অনেক স্মৃতি মনের কোণে এখনো জ্বল জ্বল করছে। এই স্মৃতিগুলো যখনই কোন প্রসংগে মনে পড়ে তখন নিজের অজান্তেই চোখের কোণেও জল জমে যায়। জীবনের সত্তুর দশকেও ইচ্ছে হয় যদি ফিরে পেতাম ওই প্রাণোচ্ছল দিনগুলো!!!
বলতে চাইছিলাম সেই আরাকানের মহামান্য সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো ১৮৬৩/৬৪ তে কুশীনগর বন্দনায় এসে স্থানীয় বৌদ্ধদেরকে যেভাবে কুসংস্কার আর বিকৃত ধর্মাচারে নিমজ্জিত দেখলেন; তাতেই তিনি মর্মাহত হয়ে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ছিলেন নিজের করণীয় কি হবে। সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরোর এই সংকল্পই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ১৮৬৪খৃষ্টাব্দ থেকে প্রায় ১৯৬০ খৃষ্টাব্দ সময় পর্বটিতে জন্ম দিল একশত বছর প্রলম্বিত ইতিহাসে সদ্ধর্মের পুণরুত্থান পর্বটির।
সৌভাগ্যক্রমে আমার জন্ম ১৯৫০ এ। সেই সুবাদে তখনকার আট দশটি বড়ুয়া বৌদ্ধ পল্লীর ধর্ম ও সামাজাচারের স্মৃতিচারণ করা আমার দ্বারা সম্ভব। তাতে বলতে পারেন ভিক্ষু প্রজ্ঞাবংশ কমপক্ষে একশো বছরের ইতিহাসের এক প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। এসময়ে আমি দেখেছি দুই চারটি বিহার মিলে, এমন কি আট দশটি বিহারের দায়িত্ব পালন করতেন শুধু একজন মাত্র ভিক্ষু। সেই ভিক্ষুকে ধর্ম দায়িত্ব পালন করতে হতো এসকল ক্ষুদ্র বৌদ্ধ পল্লী সমূহে। শুনেছি তখন সমগ্র নোয়াখালী আর কুমিল্লা এলাকার বৌদ্ধগণের ধর্মদায়ীত্ব পালন করতেন মীরসরাই দমদমা অভয়শরণ বিহারাধক্ষ্য ভদন্ত অভয়শরণ মহাস্থবিরের পর আমার জন্মগ্রাম জোবরার সন্তান গুণালঙ্কার মহাস্থবির মহোদয়।
ধর্মবিনয় জানা ভিক্ষুদের এই সংখ্যা স্বল্পতার সুযোগ পুরোটাই নিয়েছিলেন প্রতিবেশী হিন্দু ব্রাম্মণ আর বৈষ্ণবেরা। বৌদ্ধ পল্লীগুলোতে তাঁদের অবাধ বিচরণ ছিল আরাকান সম্রাজ্যের পতন কাল ১৬ শ শতক থেকে।
তাঁদের এই অবাধ বিচরণের প্রভাবে মোগল আমল পরবর্তী বৃটিশ আমলে পর্যন্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দ্বারা চিহৃিত করা সম্ভব হয়নি যে ; বড়ুয়া চাকমা মারমারা বৌদ্ধ। তাই তাঁরা আমাদের কে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ বিবেচনায় বৌদ্ধগণকেও হিন্দু পারিবারিক আইনের আওতা ভূক্ত করেছিলেন। সেই অভিশাপ হতে এখনো আমরা মুক্ত হতে পারিনি।
এমন নাজুক পরিস্থিতিতেই আমাদের ভাগ্যাকাশে উদিত হলেন মহাসূর্য মহামান্য সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো। তাঁরই হাত ধরে, তাঁর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে তখনকার যেই কয়জন ভিক্ষুরা বৌদ্ধিক জীবন ও ধর্মের প্রকৃত পরিচয় লাভে সক্ষম হন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বর্তমান রাউজান উপজেলার পশ্চিম গহিরার হালদা নদীর তীরবর্তী বৈজয়ন্ত বিহারাধিপতি রাম মণি মহাথেরো। তিনি সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরো মহামুণি পাহাড়তলীর মহানন্দ সংঘরাজ বিহারে অবস্থান কালে তাঁর নিকটে প্রব্রজ্যা উপসম্পদা গ্রহণকারীদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। এই রাম মণি মহাথেরোর নিকটে প্রব্রজ্যা গ্রহণকারীদের অন্যতম ছিলেন চতুর্থ সংঘরাজ বরজ্ঞান মহাস্থবির এবং আমার জন্ম গ্রাম জোবরার ভিক্ষু মুণিন্দ্রপ্রিয়(বড়ুয়া ভিক্ষুদের মধ্যে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সংস্কৃত ও পালিটোল হতে প্রথম বিনয় বিশারদ উপাধী প্রাপ্ত ভিক্ষু)।
সেই ভিক্ষু মুণিন্দ্র প্রিয় ছিলেন আমার আপন ঠাকুর দাদার আপন ছোট ভাই। সেই মুণিন্দ্র প্রিয় ভিক্ষু বর্তমান জোবরা সুগত বিহারের জন্মদাতা এবং জোবরার কীর্তিমান সন্তান উপ-সংঘরাজ গুণালংকার মহাথেরোর প্রব্রজ্যা গুরু। শ্রামণ গুণালংকার পরবর্তীকালে সংঘরাজ বরজ্ঞান মহাথেরোর নিকটে উপসম্পদা গ্রহণ করে গুণালংকার ভিক্ষু নামে আত্মপ্রকাশ করেন।
তখনকার সময়ে সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরোর অবস্থান কে কেন্দ্র করে মাহামুণি পাহাড়তলীতে তিন মাস বর্ষাব্রত শেষে প্রবারণা পূর্ণিমার পরের দিন ভিক্ষুদের সমাগম হতো। সেই ধারাবাহীকতা এখনো সংঘরাজ ভিক্ষু মহামন্ডল বজায় রেখেছেন । সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ভিক্ষুরা কমপক্ষে পাঁচ জনের দল গঠণ করে নানা এলাকার বৌদ্ধ পল্লীসমূহে ধর্ম প্রচার আর সমাজ সংস্কারের অভিযান পরিচালনা করতেন। তাতে বৌদ্ধ সমাজ ধীরে ধীরে নিজ ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে যেমন সক্ষম হলেন ; সেই সাথে অবৌদ্ধ আচার সংস্কার সমূহ বর্জনও শুরু করলেন। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের এই আন্দোলন কে আরো ব্যাপক আর শক্তিশালী করারা লক্ষ্যেই চতুর্থ সংঘরাজ বরজ্ঞান মহাথোরো সংঘরাজ ভিক্ষু মহামণ্ডলের(পূর্বের ভিক্ষু সমাগম) সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ পরে তিনি হাটহাজারী, কুমিল্লা(ত্রিপুরা), মীরসরাই(নিযামপুর পরগণা), ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনীয়া, সহ আরো কিছু এলাকা হতে একদল ভিক্ষু ভদন্ত প্রজ্ঞালোক, বংশদীপ, আর ভদন্ত জ্ঞানীশ্বরের অধ্যয়নপীঠ শ্রীলংকার পানাদুরা সদ্ধম্মোদয় পিরিবেন এ প্রেরণ করেন।
তাঁদের মধ্যে মাত্র দুই শিক্ষার্থী কালে স্মরণীয় বরণীয় হতে পারলেন। একজন উপ-সংঘরাজ গুণালংকার মহাথেরো ; অপর জন ভারতীয় প্রথম সংঘরাজ ভদন্ত পন্ডিত ধর্মাধার মহাথেরো। আমার বর্তমান আলোচনা উপ-সংঘরাজ ভদন্ত গুণালংকার মহাথেরো কে নিয়ে।
জোবরা গ্রামে জন্ম নেয়া এই কীত্তিমান সন্তানটি ভিক্ষু জীবন গ্রহণের পর নিজেকে যেভাবে গঠণ করেছিলেন আর সমর্পন করেছিলেন বুদ্ধপূজায় ; তার বিস্তারিত বর্ণনা নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে ছাপানো জীবনীতে পাওয়া যাবে। তাই আমি এসবের পুনরুল্লেখ না করে শুধু সাংঘিক জীবনে তাঁর সাফল্য টুকু এখানে তুলে ধরছি। এই কীর্তিমান ভিক্ষুর হাতে জন্ম নিলেন প্রায় অর্ধশত শিষ্য । তন্মধ্যে কুমিল্লার লাকসামের ভদন্ত পূর্ণানন্দ মহাথেরো ; দশম সংঘরাজ পন্ডিত জ্যোতিপাল মহাথেরো; আগরতলার ডক্টর বুদ্ধদত্ত মহাথেরো ; ত্রয়োদশ সংঘরাজ ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো ; বিদর্শনাচার্য ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরো (হাইদচকিয়া;ফটিকছড়ি) অন্যতম।
ভদন্ত পূর্ণানন্দ মহাথেরোর হাতে জন্ম নিলেন পুরাতাত্বিক গবেষক ভদন্ত ধর্মরক্ষিত মহাথেরো(?) ; ভদন্ত জিনালংকার মহাথেরো প্রমূখ গুণী ভিক্ষুরা। ভদন্ত জ্যোতিপাল মহাথেরোর হাতে জন্ম নিলেন ভদন্ত শীলভদ্র প্রমূখ কীত্তিমান ভিক্ষুরা।
ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো হতে জন্ম নিলেন উপ-সংঘরাজ ভদন্ত প্রিয়দর্শী মহাথেরো ; ডক্টর ভদন্ত রতনশ্রী মহাথেরো(কোলকাতা) ; ডক্টর শরণপাল(কানাডা); ভদন্ত শাসনানন্দ মহাথেরো; সহ পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের নেতৃত্ব ভদন্ত বিমলতিষ্য মহাথেরো(কোলকাতা); ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো(মীরপুর;ঢাকা) ; ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথেরোর মতো কীত্তিমান ভিক্ষু (মোনঘর,রাঙ্গামাটি) ; সহ প্রায় শতাধিক শিষ্য প্রশিষ্য।
অপরদিকে বিদর্শনাচার্য ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরোর হাতে জন্ম নিলেন ভিক্ষু জ্ঞানজ্যোতি মহাথেরো(শিলিগুড়ী) ; ভদন্ত প্রজ্ঞামিত্র মহাথেরো(উত্তর মিঠাছড়ী,রামু) ; ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো (লসএন্জেলেস; আমেরিকা); বিদর্শনাচার্য ভদন্ত প্রজ্ঞেন্দ্রিয় থেরো (শীরঘাটা; সাতকানিয়া) ; ভদন্ত জ্ঞানেন্দ্রিয় থেরো(জলদী; বাশঁখালী); এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যোতিষ বড়ুয়া ও ডক্টর পিন্টু মুৎসুদ্দি(বিভাগীয় প্রধান ; রাঙ্গুনীয়া কলেজ) ; প্রমূখ কীত্তীমান গণ সহ প্রায় শতাধিক গুণী শিষ্য প্রশিষ্যবৃন্দ।
বর্তমান বাংলা ভাষাভাষী বড়ুয়া ;চাকমা ও মারমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে উপ-সংঘরাজ ভদন্ত গুণালংকারের শিষ্য প্রশিষ্যগণের অবদান জাতীয় ও আন্তর্জিক পরিমন্ডলে এতই বিশাল ও ব্যাপক যে তা সত্যিই অবিস্মরণীয়। এই আলোকে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক, সাংগঠনিক, লেখনি, আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণময় অবদান গুলো ধারাবাহিক ভাবে তথ্যভিত্তিক তুলে ধরলে অন্যান্যরাও অনুপ্রাণিত হবেন। আর তাতেই গড়ে উঠবে বড়ুয়া বৌদ্ধ জাতির এক সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্য।
সবাই সত্য ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করুক। করণ ইতিহাস জাতিকে অতীত থেকে শিক্ষা নিতে সহায়তা করে। ইতিহাস বর্তমান কে তুলনামূলক যাচাইয়ে সহায়তা করে। ইতিহাস ভবিষ্যৎতের কর্মপন্থা নির্ধারণে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে।
ভবতু সব্ব মঙ্গলম!
Leave a Reply