অমরত্ব ও শ্রদ্ধেয় শাসনজ্যোতি সংঘরত্ন
এস . লোকজিৎ থেরো
“ন অন্তলিক্খে ন সমুদ্দমজ্ঝে
ন পব্বতানং বিবরং পবিস্স ,
ন বিজ্জতি সো জগতিপ্পদেসো
যত্থটঠিতং নপ্পসহেয়্য মচ্চু ।” (ধম্মপদ ১২৮)
অর্থাৎ -জগতে এমন কোন প্রদেশ বিদ্যমান নাই , যেখানে অবস্হিত ব্যক্তিকে মৃত্যু বিনাশ করে না ,
অন্তরীক্ষে নহে , সমুদ্রমধ্যে নহে , পর্বতগুহায় প্রবেশ করেও নহে। তাই”জগতের সমস্ত কিছুই অনিত্য “ এই সত্য প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিই সম্যক রূপে উপলব্দি করতে পারে । আবার যে কোন বুদ্ধিমান মানুষ লৌকিয়ভাবে অনুবেদ জ্ঞানে দর্শন করতে পারেন জগত যে অনিত্যময় তবুও মানুষ পৃথিবীতে বহুকাল বেঁচে থাকতে চাই , চাই অমরত্ব । মানুষের কত সাধনা , কত প্রচেষ্টা , কত গবেষণা এখনো চলমান অমরত্ব লাভের আশায় কিন্তু জগত যে অনিত্যময় এই সত্যই এখনো পৃথিবীতে বিদ্যমান । আজ অবধি কোন মানব দেহজ ভাবে অমরত্ব লাভ করতে পারে নাই ।
প্রচলিত একটি ঐতিহাসিক কাহিনী আছে সম্রাট আলেকজেন্ডার ভারতবর্ষ বিজয়ের পর এক সাধকের সন্ধান পান যিনি অমরত্বের সন্ধান দিতে পারেন বলে অনেক মনে করতেন কারণ সেই সাধক প্রায় দুইশত বছরে কাছাকাছি জীবিত ছিলেন ।কথিত আছে সম্রাট আলেকজেন্ডার অমরত্ব লাভের জন্য এই সাধকের কাছে গিয়ে ছিলেন এবং সাধক তাকে একটি গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে প্রবেশের মাধ্যমে ছোট একটি পুকুর পানি পান করার কথা বলেন । যে পানি পান করলে অমরত্ব লাভ হয় । সাধকের দিকনির্দেশনা অনুসারে তিনি গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেন পুকুরের কাছাকাছি যাবার পর তিনি চিন্তা করলেন যদি সৈন্যদের সাথে করে নিয়ে যায় এবং তারা যদি সেই পানি পান করেন তখন তারাও অমরত্ব লাভ করবে সুতারাং তাদেরকে সাথে করে নেওয়া যাবে না , তাই তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে আলেকজেন্ডার একাই গেলেন পুকুরের ধারে , গিয়ে দেখতে পেলে ছোট পুকুর পরিস্কার পানি ,আনন্দ মনে পানি পান করার জন্য দুহাতে এককোজ পানি নিলেন ,এমন সময় একটি কাক পাখি বলে উঠল “ হে সম্রাট আলেকজেন্ডার আপনি তো অমরত্ব লাভের জন্য পানি পান করবেন , তা ঠিক আছে তবে আপনি কি চিন্তা করেছেন যদি আপনি অমরত্ব লাভ করেন তবে আপনার জীবনটা কেমন হবে ? আমি এই পুকুরের পানি পান করে অমরত্ব লাভ করে প্রায় একহাজার বছর বেঁচে আছি , কিন্তু আমার সব আপনজন মৃত্যুবরণ করেছেন , যাদেরকে আপন করে ভালোবাসি তারা এক সময় মৃত্যু বরণ করে কিন্তু আমার মৃত্যু হয় , প্রিয়জন হারানোর বেদনা নিয়ে আমি আর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চাই না , আমি প্রতিদিন এখন মৃত্যুকে খুঁজি কিন্তু আমার মৃত্যু হয় না , অমরত্ব আমার কাছে এখন দুর্বিসহ জীবন “ ।
আপনি চিন্তা করে এই অমরত্ব পানি পান করুন । কথাটা সম্রাট আলেকজেন্ডার কে চিন্তিত করলো ,মনে মনে ভাবলেন সকল প্রিয়জন যদি হারিয়ে যায় তবে আমার অমরত্ব নিয়ে কি হবে ? অসংখ্য প্রিয়জন হারিয়ে অমরত্ব লাভের প্রয়োজন কি ? তাই। সম্রাট অমরত্ব পানি পান না করে ফিরে আসলেন । সম্রাট আলেকজেন্ডার দেহজ ভাবে অমরত্ব লাভ না করলেও তার বীরত্ব তাকে অমরত্ব করে দিয়ে হাজার বছর ধরে ।
ঠিক এই রূপ ভাবে পৃথিবী কিছু মানুষের আবির্ভাব হয় যাদের কর্মের মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করে লক্ষ কোটি মানুষের প্রানে হাজার বছর ধরে । মানব কল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরাই প্রকৃতভাব মানব অন্তরের ভিতর দিয়ে অমরত্ব লাভ ।সেই রূপ অমরত্ব লাভের কর্মে নিবেদিত ছিলেন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা কর্তৃক “শাসনজ্যোতি” উপাধিতে ভূষিত , আমার পরম কল্যাণকামী, হাইদচকিয়া গৌতমাশ্রম বিহারের অধ্যক্ষ সদ্ধর্মজ্যোতি এস এম সংঘরত্ন মহাথেরো মহোদয় । তিনি এমন একজন গুণী , যতদিন বৌদ্ধ জাতি থাকবে ততদিন তাঁর সুকর্মের মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করবে । পরম শ্রদ্ধেয় শাসনজ্যোতি এস এম সংঘরত্ন মহাথেরো ১৯৪৮ সালে কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত রম্যভূমি রামু উপজেলার মেরংলোয়া গ্রামে ধার্মিক উপাসক পিতা লোকমোহন বড়ুয়া ঔরষে ধার্মিক মাতা পন্চবালা বড়ুয়া গর্ভে জন্মগ্রহন করেন ।তাহার গৃহী নাম ছিল পটল বড়ুয়া ।
একুশে পদকে ভূষিত , অগ্গমহাসদ্ধর্মজ্যোতিকা ধ্বজ মহামান্য উপসংঘরাজ পরম শ্রদ্ধেয় পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের সান্নিধ্যে পবিত্র উপসম্পদা গ্রহন করেন । তিনি রামু শ্রীকুল মৈত্রী বিহারের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন ।ধর্মবিনয় শিক্ষা করার জন্য অনেক দিন বর্মা ছিলেন । পরবর্তী তিনি হাইদচকিয়া গৌতমাশ্রম বিহারের অধ্যক্ষপদে বরিত হয়ে আমৃত্যু এই বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন ।
দুই হাজার পাচঁ / ছয় সালে ভান্তের সাথে প্রথম সাক্ষাত হয় । পরিচয় সুত্রে জানতে পারেন আমি ড. অর্থদর্শী বড়ুয়ার ( এস .জ্ঞানপ্রিয় ভিক্ষু ) ছোট ভাই সেই থেকেই তিনি আমার ভাই বলে ডাকতেন । উল্লেখ্য এস জ্ঞানপ্রিয় ভিক্ষু ( তখন তিনি বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার যুগ্নমহাসচিব ছিলেন ) মাধ্যমে গ্রামবাসীর প্রার্থনায় হাইদচকিয়া গৌতমাশ্রম বিহারের অধ্যক্ষপদ গ্রহন করেন ।
তিনি বলতেন অর্থদর্শী আমার ভাই তুমিও আমার ভাই , যেখানেই দেখা হতো ভাই ছাড়া কথা বলতেন না , শ্রদ্ধাবান উপাসক বিশিষ্ট সমাজ সেবক প্রকৌ মৃঙ্গাগপ্রসাদ বড়ুয়া সহ গ্রামবাসীর আহবানে কয়েকবার ভান্তের বিহারে কঠিন চীবর দানে গিয়েছিলাম , ভান্তের স্নেহভরা যে আদর ভালোবাসা পেয়েছি তা আজীবন মনে থাকবে । আমি বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার মহাসচিব হিসাবে দায়িত্ব থাকাকালে ঐতিহ্যবাহী পুণ্যতীর্থ চান্দগাঁও সার্বজনীন শাক্যমুনি বিহারে শেষবারে মত এসেছিলেন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা কর্তৃক প্রাপ্ত “শাসনজ্যোতি “ উপাধি গ্রহন করার জন্য । তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন এবং অনুষ্টানে অনেক উপাসক উপাসিকা নিয়ে যোগদান করেছিলেন । যাবার সময় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অনেক আশির্বাদ করেছিলেন । মনে হয় হাসিমুখে এইটাই শেষ দেখা কারণ পরে যতবার দেখা হয়েছে তত বার রোগ ব্যাধির কথায় বার বার বলতেন ।
মাঝে মাঝে তাহার প্রিয় শিষ্য ত্রিশরণ বুদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ , তরুণ ভিক্ষুরবি প্রিয়ভাজন কেডি বোধিরতন ভিক্ষুর কাছে ভান্তের খবর পেতাম । গত ২২ মে ২০২১ ইং বোধিরতনই খবর দিল তার গুরু ভান্তে মহাপ্রয়ান করেছেন । শুনার সাথে সাথে সেই স্মৃতিময় দিন গুলোর কথা খুব মনে পরতে লাগলো । এই করোনা ভাইরাস সময়ে কত প্রিয়জন চলে গেল যদিও ভান্তে করোনা রোগী নয় তথাপি সব জায়গায় লকডাউন চলছে অস্হির একটি সময় চলমান , এই অল্প সময়ে প্রবীন , মধ্য, তরুন অনেক ভিক্ষু অতিদ্রুত সময়ে মৃত্যু বরণ করেছে , যা শাসন সদ্ধর্মের মহাক্ষতি সাধিত হয়েছে । এই মিছিল কখন থামবে জানি না । তিনি ছোটদের প্রতি খুবই আন্তরিক ছিলেন , ফটিকছড়ি এলাকার যে কোন অনুষ্ঠানে সব সময় উপস্হিত থাকতেন । তাহার ধর্মদেশনা সবাইকে মুগ্ধ করতো। রামুতে জন্মগ্রহন ও পবিত্র ভিক্ষু জীবন শুরু করলেও অত্র এলাকার সকল মানুষকে আপন করে নিয়েছিল ।শেষ জীবনের দীর্ঘ সময় এখানেই অতিবাহিত করলেন । তাহার জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হলেও তাহার কর্ম প্রদীপ এখনো বিদ্যমান , বুদ্ধের অমৃতবাণী বক্ষে ধারণ করে মানবকল্যাণে আজীবন কাজ করে গেছেন , সম্পদ প্রাচুয্য পরিবারে জন্মগ্রহন করলেও সেগুলো তুচ্ছ করে আজীবন সাদাসিধে জীবন অতিবাহিত করেছেন । তাঁহার জীবনের আয়ুর নিয়ম সময়ে তিনি চলে গেলেও আমাদের কাছে অসময় কারণ তাহার মতো গুণী ভিক্ষু সমাজে বিরল । তবে এইটা সত্য তাহার সৃষ্টি কীর্তিমালা তাঁহাকে অমরত্ব দান করবে ।
তাই কবিতার ছন্দে বলি – “তোমার দেহজ মিশে যেতে পারে মৃত্যুর আলিঙ্গনে
তোমার কীর্তি হৃদয় অলিন্দে রবে চিরকাল ধরে,
মৃত্যুর কাছে সব বিলিন হয় অনিত্য নিয়ম ধরে
কর্মগুণী সত্যসন্ধানী প্রানে প্রানে অমরত্ব রহে ।”
জয়ুত সংঘরত্ন মহাথের
জয়ুত বুদ্ধ শাসনম
Leave a Reply