মহাপন্ডিত দার্শনিক বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির ভান্তের সংক্ষিপ্ত জীবন কথা
দার্শনিক নামে খ্যাত পন্ডিত বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির ৫ অগ্রহায়ণ ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ,বৃহস্পতিবার রাঙ্গুনিয়ার অন্তর্গত নজরেরটিলা গ্রামে এক সম্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৃত্যুঞ্জয় বড়ুয়া এবং মাতা রমাবতী বড়ুয়া। তাঁর গৃহী নাম ছিল সতীশ চন্দ্র বড়ুয়া, তাঁর তিন বোন,তিনি সকলের কনিষ্ঠ।
১২৫৯ মঘীয় তুফানের সময় তিনি পাঁচ বৎসরের শিশু ছিলেন। মাত্র অাট বৎসর বয়সে ভাগ্যের বিড়ম্বনায় পিতৃহারা হন তিনি।তখন মাতুলালয়ে গিয়ে রাঙ্গুনিয়া ফ্রি প্রাইমারী বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অত্যন্ত মেধার পরিচয় দেন।উক্ত স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে মধ্য বাংলা বিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন।সেখানে তিনি উচ্চ প্রাইমারী মধ্য বাংলা বৃত্তি পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়ে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে চট্রগ্রাম নর্মাল স্কুলে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাঁচশত পরীক্ষার্থীর মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করে বৃত্তিলাভ করেন । স্কুল শিক্ষকগণ তাঁকে যথেষ্ট অাদর ও স্নেহ করতেন।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ বৌদ্ধ দেশ রেঙ্গুনে চলে গেলে ও নানা সমস্যার দরুণ সেখান থেকে ভ্রাতুষ্পুত্র প্রেমলালকে সঙ্গে নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।একদা বেতাগী গ্রামজাত কৃতি সন্তান ওভারসিয়ার শ্রী দ্রোণকুমার বড়ুয়ার সঙ্গে সতীশ বাবু অালোচনাক্রমে তাঁর পাণ্ডিত্য ও মেধার পরিচয় পেয়ে বেতাগী প্রাইমারী বিদ্যালয়ের প্রদান শিক্ষকরুপে শিক্ষা দায়িত্ব নেওয়ার অাহ্বান জানান।তাতে তিনি( সতীশ বাবু) সম্মত হয়ে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।তাঁর কর্মদক্ষতা এবং জ্ঞান প্রাচুর্য গ্রামবাসীকে মুগ্ধ ও তাঁর প্রতি অনুরক্ত করে তোলেন।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দ স্বগ্রামের নিরঞ্জন নামক কুমারীর সঙ্গে শুভ পরিণয় সূত্রে অাবদ্ধ হন।সংসার জীবনে তিনে দীর্ঘস্থায়ী না হয়ে ২৩ বছর বয়সে অাচার্য শ্রীমৎ ধর্মানন্দ মহাস্থবিরের ছত্রছায়ায় প্রব্রজ্যা এবং উপসম্পদা গ্রহণ করেন।তখন তাঁর নাম হয়েছিল ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ গুরুদেবের অনুপ্রেরণায় ত্রিপিটক শাস্ত্র শিক্ষার জন্য বৌদ্ধদেশ শ্রীলঙ্কা যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
ইতিমধ্যে অগ্গমহাপন্ডিত ধর্মবংশ মহাস্থবিরের সাক্ষাৎ হলে তাঁকে উচ্চ শিক্ষার জন্য উৎসাহিত করেন।তাঁরই প্রচেষ্টায় ওয়েন্টাল একাডেমীতে ভর্তি হন। এখানে পড়ার সময় রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাস্থবিরের সাক্ষাৎ হলে তাঁকে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করলে শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে কলিকাতা যাত্রা করেন।তখন কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ ধর্মাংকুরে উপস্থিত হলে শ্রীলঙ্কার যাওয়ার পূর্বে হিন্দু ও সংস্কৃত শিক্ষার কথা উল্লেখ করেন।
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ লক্ষ্মৌ থেকে রামচন্দ্র শাস্ত্রীর নিকট হিন্দি ও সংস্কৃত শিক্ষা শেষে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ শ্রীলঙ্কা যাত্রা করেন।তিনি সেখানে তিন বৎসর বিভিন্ন অাচার্যের নিকট ত্রিপিটক শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করে পুনরায় লক্ষ্মৌতে এসে অবস্থান করেন। সেখানে অনেক সুপন্ডিত্যের সঙ্গে বিভিন্ন শাস্ত্র সম্পর্কে তর্কযুদ্ধে স্বীয় মতামত যুক্তিসহকারে বাস্তব বিষয়টি ফুটিয়ে তুলে অনেককে তাঁর মতাদর্শে উদ্ধুদ্ধ করেন। তখন কাশিপুর স্টেটের মহারাজ কুমার অনন্ত সিংহকে তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দান করেন।
রাঙ্গামাটিস্থ পার্বত্য এবং বাঙ্গালি বৌদ্ধদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত ” অানন্দ বিহার” অাজ বিশাল প্রতিষ্ঠানরুপ লাভ করেছে যা দার্শনিক বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবিরের অক্ষয়কীর্তিকে ধারন করে অাছে।
অতঃপর ফটিকছড়িস্থ হাইদচক্ষ্যা গৌতমাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার পরিবারের সদয় প্রার্থনায় ধর্মতথা শিক্ষার বিস্তারে ব্রতী হয়ে তথায় অবস্থান করেন।তখন তরুণ ভিক্ষু সুগত ও বিমলানন্দ তাঁর সেবক হিসেবে থেকে ধর্ম বিনয় শিক্ষা করেন।
সুভূতি,শরণতিষ্য,জীবানন্দ,মেধানন্দ প্রভৃতি শ্রামণগণ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।এর একবৎসর কাল পরে তিনি রাউজান থানাধীন বৌদ্ধ জন বহুল বিনাজুরী শ্মশান বিহারের অধ্যক্ষপদে বরিত হয়ে ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাছাড়াও অত্র বিহারের জীর্ণ শীর্ণ অবস্থা দেখে গ্রামবাসীদের অার্থিক সহায়তা নিয়ে সংস্কার সাধনে পুনরুজ্জীবন দান করেন।তিনি কয়েক বছর অত্র জীবনে অবস্থান করে অাপামর জনসাধারণের মধ্যে নতুন করে বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষার যে পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন তা এখনও অনেকের মনে চির জাগরুক হয়ে অাছে।
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলিকাতায় বেঙ্গল বুডিষ্ট এ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক শ্রী অবিনাশ বড়ুয়া ( বাড়ি রাঙ্গুনিয়া, ইছামতি) তথা সভ্যগণ তাঁকে সভাপতি এবং বিহারের অধ্যক্ষপদে বরিত করার প্রস্তাব জানান। প্রতিষ্ঠান এবং স্বজাতির স্ব- সংস্কৃতি ও সদ্ধর্ম রক্ষায় তিনি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ কলিকাতা গিয়ে উক্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাছাড়াও ড. বি. এম. বড়ুয়া কর্তৃক ১৯৩৫ ইংরেজি প্রতিষ্ঠিত ” নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের দায়িত্বভারও গ্রহণ করেন। বলতে দ্বিধা নেই সেই সময়ে কলিকাতায় বাঙালি বৌদ্ধরা দ্বিধিবিভক্ত ছিল।তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি এবং দূরদৃষ্টিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন তা নয় সমাজের সার্বিক উন্নয়নে অান্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতা অানায়ন করতে সক্ষম হন।তাঁর অসাধারণ প্রতিভা এবং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা দ্বারা উচ্চ শিক্ষিত বৈদিক তথা হিন্দুগণ বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হন।তৎমধ্যে কবিগুরুর ভ্রাতুষ্পুত্র প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
এই সময় সিমলা ওয়েভেল কনফারেন্সে জাতীয় দাবী উত্থাপনের উদ্দেশ্যে তৎকালীন সম্পাদক ড.অরবিন্দু বড়ুয়াসহ সিমলা যাত্রা করেন। সেখানে পন্ডিত জহরলাল নেহেরু মহত্নাগান্ধী এবং অাবুল কালাম অাজাদের সাথে অালোচনাকালে তাঁদের অভিপ্রায় পেশ করেন।তাছাড়াও সে সময় জাপান কর্তৃক অাক্রান্ত হলে বার্মার প্রধানমন্ত্রী তথায় বাঙালি বৌদ্ধদের অবস্থান বিষয় অবগত হয়ে বাঙ্গালি বৌদ্ধদের জন্য যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।কিন্তু নেতৃত্বদান কারীদের মধ্যে দ্বিমত পোষণ করায় সেই সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে ও সদব্যবহার করতে না পাড়ার দরুণ অাজ এবং ভবিষ্যতে ও দুর্ভোগে থাকতে হবে বাঙ্কে বৌদ্ধ সমাজকে।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ শারীরিক অসুস্থতার দরুণ তাঁর অালোকিত ও প্রিয় শিষ্য পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরকে চট্রগ্রাম থেকে কলিকাতায় নিয়ে গিয়ে যাবতীয় দায়-দায়িত্ব দিয়ে তিনি চট্রগ্রাম ফিরে অাসেন। তিনি কলিকাতা এবং চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পুণ্যতীর্থ আবদুল্লাপুর শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারে অবস্থানকালীন সময়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রস্থ রচনা করেন তমধ্যে ” সত্যদর্শন” গ্রস্থটি অন্যতম, তা ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ প্রকাশিত হয়।
এই অমূল্য গ্রস্থের ভূমিকায় ড. নলিনাক্ষ দত্ত মন্তব্য করেছেন – বৌদ্ধ দর্শন সম্বন্ধে এইরুপ পান্ডিত্যপূর্ণ গ্রস্থ এই প্রথম দেখিতে পাইলাম।তাছাড়া ও তিনি ” দর্শনে অালোর” ” পটিসম্ভদামগ্গে বঙ্গানুবাদ, বিশ্বমঙ্গল ( বর্তমান তাঁরই নাতি ভিক্ষু পূর্ণজ্যোতিকে লেখন তা প্রকাশের সম্মতি নিয়ে হাতে তুলেদিয়েছি। ভক্তিশতকম ” গ্রস্থ ব্যতীত অনেক প্রবন্ধ ও অভিভাষণ রচনা করে গেছে যা অমূল্য রত্নসম্পদ বললেও অতুক্তি হয় না। তাঁর শিষ্য – প্রশিষ্যদের মধ্যে মহাপন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির, সুমনাচার মহাস্থবির, সুগতবংশ মহাস্থবির, গিরিমানন্দ মহাস্থবির, অরুণালোক মহাস্থবির, মেধানন্দ,শুদ্ধানন্দ মহাস্থবির এবং কবি সম্বোধি মহাস্থবির প্রমুখ।তাঁরা সকলেই শাসন সমাজের এক একজন দিকপাল বললেও অত্যুক্তি হয় না।পঞ্চবিংশতি বুদ্ধ জয়ন্তী সভাপতি হিসাবে কোঠেরপাড়া বৌদ্ধ বিহারে ১৬ পৃষ্ঠার যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি ছাপা অাকারে প্রদান করেছেন তাতে তাঁর অগাধ পান্ডিত্যের পরিচয় মেলে।
সাধনপীঠ বিনাজুরী শ্মশান বিহারে অবস্থানকালীন সময়ে মূল মন্দিরে সিংহশয্যায় বুদ্ধমূর্তি, ধর্মচক্র বুদ্ধমূর্তি এবং মহামায়াদেবীসহ বুদ্ধের জন্মস্মৃতির মূর্তি স্থাপনা করা হয়।মৃত্তিকা শিল্পী নরহরি অাচার্য্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবিরের সার্বিক শিল্প নির্দেশনায় এরকম শিল্পশোভন সুষমামন্ডিত বুদ্ধমূর্তি বিনাজুরী শ্মশান বিহারে স্থাপন করে বিহারের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করেছিলেন এবং অত্র এলাকার অাপামর জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় জাগরণে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
সেখান থেকে তিনি অাব্দুলাপুর শাক্যমুনি বিহারে অবস্থান করে তাতেও বিহারের সার্বিক উন্নয়ন ও ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। উল্লেখ্য যে তাঁরই অন্যতম শিষ্য গিরিমানন্দ মহাস্থবিরের ব্যবস্থাপনায় তাঁর সপ্ততিতম জয়ন্তী উৎসব বিনাজুরী শান্তিনিকেতন বিহারে অনুষ্ঠিত হয়।সেখান থেকে তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য শ্রীমৎ গিরিমানন্দ মহাস্থবিরের প্রার্থনাক্রমে বিনাজুরী শান্তিনিকেতন বিহারে এসে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তদানীন্তন সংঘরাজ অভয়তিষ্য মহাস্থবিরের সভাপতিত্বে অনিত্যসভা ও শেষকৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।তাঁর মত বহুমুখী প্রতিভাদীপ্ত সাংঘিক ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত দুর্লভ।তিনি থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন।
Leave a Reply