সনাতন ধর্ম ও বুদ্ধ ধর্মের অনুসারীগণ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতারিত জনগোষ্ঠি! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ৬০ লাখ হিন্দু শরণার্থী ভারতে যায়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন যোগানোর পেছনে ভারত সরকারের অনেকগুলো কারনের মধ্যে এটাও একটা বড় কারন হিসেবে বিবেচিত। ভারত সরকার ভেবেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ হবে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ! পাকিস্থানের কবল থেকে মুক্ত হতে পারলে বাংলাদেশে হিন্দুসহ সকল ধর্মের মানুষ সমান মর্যাদায় নিরাপদে থাকতে পারবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
ক্ষমতা দখলকারী পরবর্তী সরকারগুলো বাংলাদেশকে একটি ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করে। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতকে রাজনীতিতে সম্পৃক্তকরন এবং যুদ্ধাপরাধীদেরকে মুক্ত করে দিয়ে দেশে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ করে দেয় স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান। তার সময়েই সংবিধান পরিবর্তনের পর দেশে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপর জিয়ার মৃত্যুর পর আরেক স্বৈরাচারী শাসক হোসেন.মো. এরশাদের ক্ষমতায় আরোহন দেশকে আরও ভয়াবহ অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। পীরবাদ, ধর্মীয় আখড়ায় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা এবং সংবিধানকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মগোষ্ঠীবান্ধব করে তোলাটা ছিলো কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো।
এরপর প্রয়াত স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকারের সরাসরি মদদে দেশে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতকে সাথে নিয়ে দেশকে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দিতে থাকে তারা। ধর্মীয় মৌলবাদ বিষবৃক্ষে পরিণত হয়। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী তথা হিন্দু, বৌদ্ধদের নির্যাতন, মন্দির, প্রতিমা ভাঙচুর, দেশত্যাগ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরন, সম্পত্তি বেহাত নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। দেশব্যাপী ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি শক্ত অবস্থানে পৌঁছে যায়। রাস্তার অলিতে গলিতে গড়ে ওঠে জঙ্গিবাদ বিস্তারকারী হাজার হাজার মাদ্রাসা এবং মসজিদও। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর ধীরে ধীরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ তৈরী করা হয় সুকৌশলে। এজন্য দায়ী মূলতঃ ধর্ম প্রচারক মোল্লা সম্প্রদায়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জিহাদি বাণী প্রচার চলতে থাকে। গণমাধ্যম, টেলিভিশন চ্যানেল, ওয়াজ মাহফিল, জুমার খুতবাসহ সর্বত্রই চলতে থাকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিষোদ্গার।
সবশেষে বর্তমান শেখ হাসিনার আমলেও সংবিধানে থেকে যায়- বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম। মুসলমান ছাড়া বাকিরা যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক! বিএনপি-জামায়াত জোটকে ভোট না দিয়ে হিন্দুরা ভোট দিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল এর আগে। কিন্তু আশা ছিলো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে অবস্থার পরিবর্তন হবে। কিন্তু অবস্থার উন্নতি তো হয়নি, যতোটা বেঁচেছিল তাদের আশা, সেটুকুও শেষ পর্যায়ে এখন। এই সরকারের সময়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো হয়েছে। সর্বসান্ত হয়েছে হাজার হাজার হিন্দু, দেশ ছেড়েছে কয়েকগুণ বেশি।
এখানে একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশে গত ১ জানুয়ারি – ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭ তারিখ পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ১০৭ জন মানুষ সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং ৩১ জন গুম হয়েছে বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট (বিজেএইচএম)। গত শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই চাঞ্চল্যকর দাবি করা হয়।
জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে “হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন ১ জানুয়ারি – ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭” শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন বিজেএইচএমের সাধারণ সম্পাদক পলাশ কান্তি দে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭৮২ জন হিন্দুকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয় বা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে। ২৩ জনকে অন্য ধর্মে রূপান্তরে বাধ্য করা হয়। তিনি আরো জানান, কমপক্ষে ২৫ জন হিন্দু নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়, ২৩৫টি মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়।
পলাশ কান্তি দে দাবি করেন যে, প্রশাসনের অবহেলা এবং ক্ষমতাশীলদেরকে রাষ্ট্রীয় মদদই এই অত্যাচারের প্রধান কারণ, যার ফলে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। নির্বাচনের সময় বিশ্বের অন্য কোন দেশে জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর এতো অত্যাচার হয় না, যতোটা এই দেশে হয়। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে হিন্দুদের ওপর আরও হানাহানি এবং হুমকির আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এ ব্যাপারে সরকার যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করা কঠিন কিছু হবে না।
পলাশ কান্তি দে’র মতো আমরাও আশা করবো সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রকে মুসলমানিত্বের সাইনবোর্ডমুক্ত করা হোক। রাষ্ট্র হোক সকল ধর্মের, মতের, বর্ণের মানুষের। এখানে কোন ধর্মকে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করবে না, কোন ধর্মগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে আইন ও নিয়ম নীতি তৈরী হবে না, কোন ধর্মগোষ্ঠীর ওপর কেউ চোখ রাঙাতে পারবে না, ধর্মীয় উস্কানি, সাম্প্রদায়িক বা বর্ণবাদী আচরণের উপযুক্ত বিচার ও শাস্তি দেয়া হবে। শুধুমাত্র শক্তিশালী অর্থনীতি ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র নয়, একটা সভ্য ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতে চাইলেও সরকারকে এই দাবিগুলো পূরণ করতে হবে।
Leave a Reply