সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হলেও ঘুষ খাওয়ার প্রবণতা ও দুর্নীতির হার কমেনি, বরং বেড়েছে। দেশে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা বা বাহিনী।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত যথাক্রমে পাসপোর্ট ও বিআরটিএ অফিস। ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার বেশির ভাগ মানুষই নিরক্ষর ও নিম্ন শ্রেণির। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) খানা জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক জরিপে আরো বলা হয়েছে, দেশে তিন কোটি ৭৩ লাখ খানার মধ্যে ৬৬.৫ শতাংশই দুর্নীতির শিকার। সংখ্যার হিসাবে দুর্নীতির শিকার খানা প্রায় আড়াই কোটি। ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে ৮৯ শতাংশ খানার সদস্যরা বলেছে, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। জরিপের তথ্য মতে, খানাপ্রতি গড় ঘুষ দেওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৩০ টাকা। জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। জাতীয়ভাবে ঘুষের পরিমাণ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ০.৫ শতাংশ এবং ওই বছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৩.৪ শতাংশ।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জরিপটি প্রকাশ করা হয়েছে। জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন টিআইবির প্রগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও মোহাম্মদ নুরে আলম। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল ও নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
জরিপের তথ্য মতে, ২০১৫ সালের খানা জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে ২০১৭ সালের খানা জরিপে দুর্নীতির শিকার খানার হার কিছুটা কমেছে। ২০১৫ সালে দুর্নীতির শিকার খানার হার ছিল ৬৭.৮ শতাংশ। ২০১৭ সালের খানা জরিপে তা ৬৬.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে দুর্নীতির শিকার খানার হার কমলেও গড় ঘুষ
আদায়ের হার বেড়েছে। ২০১৫ সালে ঘুষ আদায়ের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৫৩৮ টাকা। এখন সেটি বেড়ে পাঁচ হাজার ৯৩০ টাকা হয়েছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির শিকার খানার সংখ্যা কমলেও এর ব্যাপকতা রয়ে গেছে। সার্বিক পরিসংখ্যান দেখলে এটাকে কমা বলাটা ঠিক হবে না। গত দুই বছরে ঘুষ আদায়ের হারও বেড়েছে।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭২.৫ শতাংশ খানার অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গিয়ে তাদের দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। ৬৭ শতাংশ খানা অভিযোগ করেছে, পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়েছে। আর ৬৫ শতাংশ খানার অভিযোগ, বিআরটিএ অফিসে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। টিআইবি বলছে, সর্বাধিক পরিমাণ ঘুষ আদায়ের তিনটি খাত হলো গ্যাস, বিচারিক সেবা ও বীমা খাত। গ্যাসে গড় ঘুষ আদায় হয়েছে ৩৩ হাজার ৮০৫ টাকা। বিচারিক সেবায় ১৬ হাজার ৩১৪ টাকা এবং বীমা খাতে ১৪ হাজার ৮৬৫ টাকা।
টিআইবির প্রগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান জানান, আটটি বিভাগের ১৬টি স্তরে দৈবচয়নের ভিত্তিতে এক হাজার ৩২০টি গ্রাম বা মহল্লা নির্বাচন করে সেখান থেকে ১৫ হাজার ৫৮১টি খানা নির্বাচন করা হয়েছে জরিপ পরিচালনার জন্য। এসবের মধ্যে গ্রামাঞ্চল থেকে ১০ হাজার ১৫৫টি খানা এবং শহরাঞ্চল থেকে পাঁচ হাজার ৪২৬টি খানা নির্বাচন করা হয়। জরিপের তথ্য নেওয়া হয়েছে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। সেবা নেওয়ার বিবেচ্য সময় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল অনেকটা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘দুর্নীতি ও ঘুষ আমাদের জাতীয় জীবনে সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। দুর্নীতির কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। জাতিগতভাবে এমন মানসিকতা পোষণ করা অসম্মানের, অমর্যাদার। একটি দেশ আমরা স্বাধীন করেছি ঘুষ ও দুর্নীতির জন্য!’ তিনি বলেন, ‘ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধে জরুরি সরকারের সদিচ্ছা। কিন্তু সেটি দেখা যাচ্ছে না। আমরা জবাবদিহিতা দেখতে পারছি না। ’ সুলতানা কামাল আরো বলেন, বিচারব্যবস্থায়ও রন্ধে রন্ধে অনিয়ম ঢুকে পড়েছে। বিচারব্যবস্থাকে এখন আর কেউ পাত্তা দেয় না। কাউকে জামিন দেওয়া হলে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হয়। এই কাজটা মন্ত্রীরা করছেন। আমাদের বিচারব্যবস্থা কোথায় চলে গেছে?’
টিআইবি বলছে, তরুণ সেবাগ্রহণকারীদের ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার সংখ্যা কম। এই হার মাত্র ৩২ শতাংশ। একে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তার মতে, তরুণরা যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। সে কারণে তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে সাহস পায় না। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হন ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষ, যার হার ৪৬ শতাংশ। এরপর আছে ৬৫ থেকে তার বেশি বয়সী মানুষ, হার ৪৪ শতাংশ।
জরিপের তথ্য মতে, ৭০ শতাংশ নিরক্ষর মানুষ ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এসব নিরক্ষর ব্যক্তিরা খানার প্রধান। আর স্নাতকোত্তর ৫৯ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘুষের শিকার হয়েছে কৃষিকাজে জড়িত লোকজন, এ হার ৬৩ শতাংশ। পেশার দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ ঘুষের শিকার জেলে ও পরিবহন শ্রমিক। জরিপ চালাতে গিয়ে টিআইবি দেখতে পেয়েছে, দরিদ্র ও নিম্ন শ্রেণির মানুষই বেশি ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার। যাদের মাসিক আয় ১৬ হাজার টাকা, তাদের বার্ষিক আয়ের ২.৪১ শতাংশ গেছে ঘুষের বোঝা টানতে। আর যাঁদের বেতন ৬৪ হাজার টাকার বেশি, তাঁদের বার্ষিক ঘুষের বোঝা টানতে হয় ০.১২ শতাংশ।
টিআইবি জানায়, সেবা খাতের ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে জরিপ পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে যারা সেবা গ্রহণ করেছে, তাদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে জরিপটি চালানো হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, কৃষি, আইন-শৃঙ্খলাসহ ১৬টি খাত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এতে। টিআইবি বলেছে, দুই বছরে ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার খানা যে কিছুটা কমেছে তার কারণ, স্থানীয় সরকার খাতে ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সনদ ও ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া। এ ছাড়া সিওর ক্যাশ ও বিকাশের মাধ্যমে উপবৃত্তি, পাসপোর্ট সেবায় অনলাইনে ফি জমাদান এসব কারণে দুর্নীতির শিকার খানার হার কিছুটা কমেছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার নিম্ন শ্রেণির মানুষ। এটি খুবই দুঃখজনক। সরকারি খাতে বেতন-ভাতা বাড়ানো হলেও তার কোনো প্রভাব ঘুষ ও দুর্নীতিতে পড়েনি। বরং দুর্নীতি ও ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এতেই প্রমাণিত, বেতন বাড়লেও যারা ঘুষ খাওয়ার তারা খাবেই। ’
সংবাদ সম্মেলনে ১২টি সুপারিশ তুলে ধরেছে টিআইবি। সুপারিশগুলো হলো বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সেবা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকাণ্ড মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার ও তিরস্কারের বা শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে গণশুনানির মতো জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও তার কার্যকর প্রয়োগ। একই সঙ্গে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় ধাপ ও অন্যান্য বাধা দূর করতে হবে।
Leave a Reply